ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

যুদ্ধাপরাধ যুগের অবসান

01আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর সর্বশেষ মতিউর রহমান নিজামীরও ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আর সাজা ভোগ করা অবস্থায় কারাগারে মারা গেছেন গোলাম আযম। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ মাথায় নিয়ে সর্বপ্রথম কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসূফ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এভাবে একের পর এক রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ যুগের অবসান হতে চলেছে। দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করাই এখন সময়ের দাবি।  দাবি। হাইকোর্টে দলটির রাজনৈতিক নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার পর বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সংশোধিত আইন মন্ত্রিপরিষদে উঠছে শিগগিরই। এভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধ পর্বের মতো জামায়াত চ্যাপ্টারও ক্লোজ করার সময় এসেছে। যে দেশের জন্মই চাননি, যে রাষ্ট্রের অভ্যুদয় পণ্ড করতে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতেছিলেন একসময়; পরে সেই দেশের মাটিতে বেশ দাপটেই রাজনীতি করেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার এই আসামিরা। মন্ত্রী হয়ে সরকারি গাড়িতে উড়িয়েছেন জাতীয় পতাকা। তবু একাত্তরের ভুলের জন্য, অপরাধের জন্য কোনো দুঃখবোধ বা অনুশোচনা ছিল না তাদের। ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ও দায় নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছরের সাজা ভোগরত অবস্থায় ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর হাসপাতালের প্রিজন সেলে মারা যান গোলাম আযম। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির। একাত্তরের সব অপরাধের মূল হোতা বা মাস্টার মাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাকে। তিনি কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটিরও অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। জীবনে কোনো দিন একাত্তরের অভিযোগ স্বীকার করেননি। অনুশোচনা করেননি। বরং দাবি করেছেন একাত্তরে তার ও তার নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা সঠিক ছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই আদালত বলেন, সাধারণ দৃষ্টিতেও গোলাম আযমের মতো একজন ধর্মীয় নেতার আদেশ সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের চেয়েও বেশি শক্তিশালী এবং অধীনস্থরা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন। তথ্য-উপাত্তে পাওয়া গেছে যে, তার বেশির ভাগ অধীনস্থই প্যারা মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য (রাজাকার, আলবদর ও আলশামস) ছিলেন এবং তাদের সঙ্গে তার ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সম্পর্কের বিষয়টিও প্রমাণিত হয়েছে। গোলাম আযমের অপরাধ মৃত্যুদণ্ডতুল্য। তবে বয়স ও স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনা করে এ দণ্ড দেওয়া হলো তাকে। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সহযোগিতা এবং হত্যা ও নির্যাতনের সব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে। এই আসামির বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬১টি অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। রায়ে প্রমাণিত হয় সব অভিযোগ। বিচারিক আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেন গোলাম আযম। এ আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ৯২ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর পর এ মামলার আপিল অকার্যকর ঘোষণা করেন আদালত। ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এ কে এম ইউসূফ। ১৯৭১ সালে ভয়ঙ্কর খুনে বাহিনী রাজাকারের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমির। গণহত্যা, হত্যা, লুটসহ ১৩ অভিযোগে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট তার বিচার শুরু হয় ট্রাইব্যুনালে। তার মৃত্যুর পর এ মামলার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মধ্যে চূড়ান্ত আইনি প্রক্রিয়া শেষে মানবতাবিরোধী অপরাধে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় সবার আগে। তিনি ছিলেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। একাত্তরে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি। একাত্তরে নিজের অপরাধ, নৃশংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য ঢাকার মিরপুরে তিনি পরিচিতি পান ‘কসাই কাদের’ হিসেবে। বিচারে ২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তাকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার ও আসামিপক্ষ। সরকার সাজা বৃদ্ধি ও আসামিপক্ষ খালাস চায় আপিলে।

আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে। জামায়াতে ইসলামীর আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল। দলটির অন্যতম থিঙ্কট্যাঙ্ক ছিলেন তিনি। গণহত্যা, হত্যা ও নির্যাতনসহ সাত অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে তার বিচার শুরু হয়। বিচারে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। রায়ে তাকে ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেন। একাত্তরে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ছিলেন খুনে বাহিনী আলবদরের প্রধান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক সভাপতি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বিজয়ের আগমুহূর্তে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা হাতে নিয়ে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা ও গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে সেই আলবদর বাহিনীর নেতা মুজাহিদকে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সেই সাজা বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। পরে ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন করেন মুজাহিদ। সেই আবেদনও খারিজ করেন আদালত। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে গত বছরের ২১ নভেম্বর রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে, ২২ নভেম্বরের প্রথম প্রহরে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করে সরকার। বিগত চারদলীয় জোট সরকারে তিনি ছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী। যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি হিসেবে সর্বশেষ ১১ মে প্রথম প্রহরে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো রাজনৈতিক দলের শীর্ষতম ব্যক্তি ফাঁসিতে ঝুললেন। তিনি ছিলেন একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম আসামি। ৫ মে নিজামীর রিভিউ খারিজ করেন আদালত। ৬ জানুয়ারি আপিল বিভাগ তার আপিলের আবেদন খারিজ করেন। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মুজাহিদের আগে নিজামী ছিলেন আলবদর বাহিনীর প্রধান। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে প্রথমে কৃষি ও পরে শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এই মতিউর রহমান নিজামী ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিলেন নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির পরিবর্তে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। তার বিরুদ্ধে আনা হত্যা, ধর্ষণ ও ধর্মান্তর করার অভিযোগ প্রমাণিত হয় আপিলে। খালাস চেয়ে রিভিউ করেছেন সাঈদী। সাজা বাড়াতে রিভিউ আবেদন করেছে সরকার। তবে সেই আবেদনের শুনানি হয়নি এখনো। বিষয়টি আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে। দলের আর্থিক খাতের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে পরিচিত মীর কাসেম আলীর ফাঁসির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়নি এখনো। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ফাঁসির আদেশ পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন করবেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের এই সদস্য। হত্যা, নির্যাতন, অপহরণসহ বিভিন্ন অভিযোগে তার বিচার হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আবদুস সুবহানকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। আপিলে তিনি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। এ আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুট, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালে। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য।

২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মানবতাবরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। একসময় দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি ছিলেন একাত্তরে আলবদর বাহিনীর রংপুর অঞ্চলের প্রধান। তার বিরুদ্ধে আনা গণহত্যা, হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন। আপিলে খালাস চাওয়া হয়েছে।  www.bd-pratidin

পাঠকের মতামত: