ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ম্যাডাম, হেড স্যারের রুমে একা যাবেন না

70790_sssঅনলাইন ডেস্ক ::: 

‘ম্যাডাম, হেডস্যারের রুমে কখনো একা যাবেন না। তিনি খারাপ লোক। আপনার ক্ষতি করবে।’ নারী সহকর্মীর প্রতি এ কোনো শিক্ষকের সতর্কবাণী নয়। নয় কমিটির সদস্য কিংবা অভিভাবকেরও। খোদ স্কুলের কিশোর-কিশোরী ছাত্র-ছাত্রীদের এমন সতর্কবাণী নতুন নারী শিক্ষকদের প্রতি। খিলগাঁও গভ. স্টাফ কোয়ার্টার হাইস্কুলে কোনো নারী শিক্ষিকা যোগদান করলেই সেই স্কুলের ভুক্তভোগী ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছাত্রছাত্রীরাই এই বলে তাদের শিক্ষকদের সতর্ক করতো। শ্লীলতা বা সম্ভ্রম রক্ষার জন্য তার কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতো কচিকাঁচারাই। গত মঙ্গলবার ফাঁদে ফেলে শ্লীলতাহানির শিকার ওই শিক্ষিকাকেও ছাত্রছাত্রীরা সতর্ক করেছিল। গত মার্চে তার সঙ্গে স্কুলে যোগ দেয়া অপর দুই খণ্ডকালীন শিক্ষিকাকেও একইভাবে তারা রক্ষার চেষ্টা করে।
গত বছরের ১লা সেপ্টেম্বর ওই স্কুলে ৫২ বছর বয়সী বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। কিন্তু প্রথম ক্লাসে (অ্যাকাউন্টিং) গিয়েই সন্তানেরSelect Files বয়সী শিক্ষার্থীদের কাছে তেমন সতর্কবাণী শুনে তিনি একেবারে থ বনে যান। সর্বশেষ এক খণ্ডকালীন শিক্ষিকার মামলায় গত বুধবার গ্রেপ্তার হন অভিযুক্ত ব্যক্তি। পরদিন জুতা ও ঝাঁটা নিয়ে থানার সামনে মিছিল করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সরদার মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের শ্লীলতা ও সম্ভ্রমহানি এবং ইভটিজিং থেকে রেহাই পায়নি স্কুলের নারী শিক্ষকরা। দশম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীরাও। যার শেষ শিকার হলেন এমবিএতে পড়ুয়া ওই অবিবাহিত শিক্ষিকা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের প্রায় সবার এমন অভিযোগেও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও দাপটে দিব্যি স্বপদে টিকে আছেন তিনি। গত মঙ্গলবার শ্লীলতাহানির শিকার শিক্ষকের মামলায় পরদিন বুধবার গ্রেপ্তার হলেও এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন হয়নি। তবে তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে স্কুল কমিটি।
জানা যায়, এর আগে মোস্তফা কামাল ও রেজাউল করিম নামে অপর দুই খণ্ডকালীন শিক্ষককে নানা অজুহাতে বেতন বকেয়া রেখে স্কুল থেকে সরিয়ে দেন প্রধান শিক্ষক সরদার হেলাল উদ্দিন। এরপর তিনি তিনজন নারীকে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে চাকরি দেন। চাকরিতে যোগদানের পর প্রথম ক্লাসেই ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রধান শিক্ষকের নারী লোলুপ দৃষ্টি থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়। প্রথমে নতুন শিক্ষকরা বিষয়টি বুঝতে পারেননি। পরে প্রধান শিক্ষকের আচরণেই তা প্রকাশ পেতে থাকে। তিন শিক্ষকের প্রতিই তার কুদৃষ্টি। প্রথম শিকার হিসেবে বেছে নেন তার এলাকা থেকে আসা পিতৃহীন ওই নারী শিক্ষককে। গত মার্চে ওই নারী শিক্ষক প্রথম তার মাকে নিয়ে স্কুলে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে যান। সে দিনই তার কু-মতলব প্রকাশ পেলেও প্রথমে তা বুঝতে পারেননি ওই নারী ও তার মা।
ওই শিক্ষকের মা মানবজমিনকে বলেন, শিক্ষক নিয়োগের খবর পেয়ে আমি মেয়েকে নিয়ে স্কুলে তার জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে যাই। প্রথম দিনই অনর্থক আমাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টা বসিয়ে রাখে। অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলতে থাকে। ওই শিক্ষকের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে শিক্ষিকার মা বলেন, ‘আমি প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ জনকে চাকরি দিই। আপনার মেয়েকে আমার বয়সী (পঞ্চাশোর্ধ্ব) ছেলে দেখে বিয়ে দেবেন। মানুষ কী বলে কানে নেবেন না। মেয়েকে আদর-আহ্লাদে রাখবে। সুখী রাখবে।’ কিন্তু তার ওই কথার ইঙ্গিত বুঝতে পারেননি তারা। সে কথার কোনো সায়-সম্মতিও দেননি। স্বাভাবিক পরামর্শ মনে করে এড়িয়ে যান। বুঝতে পারিনি তার কু-মতলব।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওই শিক্ষিকা বলেন, ওই দিন তার সে কথার ইঙ্গিত আমরা বুঝতে পারিনি। তখন আমি বোরকা ও হিজাব পরে স্কুলে গিয়েছিলাম। পরেও তা পরেই স্কুলে যাওয়া-আসা করতাম। প্রধান শিক্ষক তা না পরতে নিষেধ করেন। স্কুলের অন্য নারী শিক্ষকরাও দেখি হিজাব-বোরকা পরেন না। তা দেখে ও প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে আমিও হিজাব-বোরকা পরা বাদ দিই। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি আমাকে বলদা গার্ডেন, হাতিরঝিল ও বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বারবার প্রস্তাব দিতে থাকেন। একপর্যায়ে প্রস্তাব দেন তিনি ১৭ লাখ টাকায় গাজীপুরে জায়গা কিনবেন। তার সঙ্গে আগামী শুক্রবার যেতে হবে। দু’ঘণ্টা অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে হবে। এছাড়া  স্কুলে গেলে আমরা তিন নতুন নারীকে শিক্ষক কমনরুমের পরিবর্তে তার কক্ষে বসতে বলেন। স্কুল দুই শিফটে পরিচালিত হলেও আমাদের সকাল প্রায় আটটা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ধরে রাখা হতো। ক্লাসে গেলে শিক্ষার্থীরা আমাদের তার কাছ থেকে সতর্ক থাকতে বলে। পরামর্শ দেয় দূরে থাকতে। অপরদিকে তিনি বলেন অন্য শিক্ষকরা খারাপ। তাদের সঙ্গে না মিশতে। আমি অবিবাহিত হলেও তিনি আমাকে বিবাহিত পরিচয় দেয়ার পরামর্শ দেন। আর আমার শরীর নিয়ে নানা মন্তব্য করতে থাকেন। বলেন, আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি। ওই পোশাক ভালো মানাচ্ছে না। তিনি আমাকে পোশাক কিনে দেবেন। জুতা কিনে দেয়ার প্রস্তাব করেন। বিভিন্ন সময় কথা বলার সময় আমার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। আমাকে প্রস্তাব করেন, তুমি আমাকে অন্তরঙ্গ সময় দিলে তিন শিক্ষকের মধ্যে সিনিয়র করে দেবে, চাকরি স্থায়ী করে দেবে। বেতন বাড়বে। আমরা তিন শিক্ষকও নিজেদের নিরাপদ করার জন্য একা তার কক্ষে না গিয়ে একত্রে যাওয়া শুরু করলাম।
এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার তিনি আমাকে কাজ শেখানোর নামে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে নেয়ার জন্য ফোন করেন। জোর করে বাসা থেকে রাস্তায় আসতে বলেন। আমিও বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে যাই। একটি রিকশায় দু’জন শিক্ষা বোর্ডে যাই। সেখানে কাজের ও ডিসি অফিসে যাওয়ার নামে নানা নাটকীয়তা ও টালবাহানা করেন। অগত্যা আমার চাপাচাপিতে চলে আসতে রাজি হন। আমাকে নিয়ে আবার রিকশায় বাসার দিকে রওনা দেন। সেদিন আকাশে রোদ বা বৃষ্টি ছিল না। তারপরও তিনি রিকশার হুট উঠিয়ে দেন। এরপর রিকশার ভেতরেই আমাকে জড়িয়ে ধরেন। একপর্যায়ে মুগদার পূর্ব মানিকনগরে বাসার কাছে এসে রিকশা থেকে নেমে যাই। কান্নাকাটি করতে থাকি। এরপর বাসায় গিয়ে মাকে সবকিছু বলি। এরপর মা তাকে ফোন করে বকাবকি করেন। তারপর স্কুলের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী, সহকর্মী ও স্কুল কমিটির সদস্যদের জানাই। ঘটনার পরদিন থানায় মামলা করি।
শুধু শিক্ষক নয়। স্কুলের ছাত্রীরাও প্রায় সময় তার হাতে যৌন হয়রানি বা শ্লীলতাহানির শিকার হতো। ওই শিক্ষিকার মামলার দিনই স্কুলের ২০ জন শিক্ষার্থী স্বাক্ষর করে আরো একটি লিখিত অভিযোগ খিলগাঁও থানায় দাখিল করেছে। যদিও তাতে মামলা হয়নি। গত বৃহস্পতিবার তাকে থানা থেকে আদালতে সোপর্দ করার দিন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা জুতা ও ঝাঁটা মিছিল নিয়ে থানায় যায়।
ওই স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী জানায়, একই স্কুল থেকে পড়ে যাওয়া আমার বড় ভাই ও বোন আমাকে তার কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। তখন তিনি শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির পরও দেখি একই অবস্থা। শারীরিক শিক্ষার পিটির ক্লাসে অকারণে নিবিড়ভাবে আমাদের শরীর ও স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিতো। জাতীয় দিবসসহ যেকোনো অনুষ্ঠানে প্রায় ছাত্রদের বাদ দিয়ে ছাত্রীদের দিয়েই উদযাপন করাতেন। তাই আমরা ছাত্রী ও নতুন শিক্ষক এলে তাদের সতর্ক করি।
ওই ক্লাসের অপর এক ছাত্রী বলেন, বিশেষ করে দশম শ্রেণির সিসি ক্যামেরা তিনি বারবার জুম করে দেখতেন। বলতেন, আমরা বাথরুমে অশ্লীল কাজ করি। তাই বাথরুমেও সিসি ক্যামেরা লাগাবেন। এর প্রতিবাদ করায় এক বিবাহিত ছাত্রীকে তিনি স্কুলে আসতে দেননি।
দশম শ্রেণির আরেক ছাত্রী বলেন, আমার গায়ে হাত দেয়া ও অনর্থক হাত ধরার প্রতিবাদ করলে তিনি বলেন, শিক্ষক ছাত্রীর হাত ধরতে পারে।
সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী বলেন, একদিন আমি স্কুলে যেতে দেরি করি। তারপর তিনি আমার বাসায় যাওয়ার বায়না খুঁজতে থাকেন।
ওই ক্লাসের অপর এক ছাত্রী বলেন, একদিন আমরা কয়েকজন ছাত্রী বাথরুমে যাচ্ছিলাম। তখন তিনি আমাদের থামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ওড়না নিয়েছো কেন? এরপর যৌন ক্রিয়া ও প্রসব ব্যথা সম্পর্কে অশ্লীল কথা বলেন।
দশম শ্রেণির এক ছাত্র বলেন, একদিন আমি হেড স্যারের কক্ষে ঢুকি। তখন দেখি তিনি দশম শ্রেণির ছাত্রী ও এক শিক্ষিকার ছবি সিসি ক্যামেরায় জুম করে দেখছিলেন।
খিলগাঁও স্কুল পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আলমগীর চৌধুরী বলেন, তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে আগে ছাত্রছাত্রীদের কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। এখন কিছু অভিযোগ পাচ্ছি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক ও খিলগাঁও পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. শাহ আলম মানবজমিনকে বলেন, তদন্ত শুরু হয়েছে। শিক্ষিকাকে যৌন হয়রানির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া স্কুলে দীর্ঘদিন ধরে তিনি অকারণে ছাত্রীদের গায়ে হাত দিতো বলে জানিয়েছে অনেকেই। বিশেষত নারীর প্রতি তার লোলুপ দৃষ্টি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিব্রত রাখতো।
মতিঝিল থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোস্তাক আহমেদ বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ফোন পেয়ে রোববার আমি স্কুল পরিদর্শন করেছি। ভিকটিম, শিক্ষক, পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে একটি প্রতিবেদন শিক্ষা অধিদপ্তরে জমা দিয়েছি। ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আগে থেকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এ বিষয়ে এ পর্যন্ত কোনো স্তরে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। মানবজমিন

পাঠকের মতামত: