ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

মাদকবিরোধী অভিযানের খবর ফাঁস করে দিচ্ছে পুলিশ!

অনলাইন ডেস্ক ::

# সবাই তো রেড দিতাছে তোমার বাসায়।
# এখন রেড দিতাছে ভাই?
# দিবে, আমরা ক্যাম্পে ঢুকতেছি।
# আচ্ছা ভাই আমি দেখতেছি।

এগুলো রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের চিহ্নিত এক মাদককারবারির সঙ্গে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) হাসানুর রহমানের মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অংশবিশেষ। মোহাম্মদপুর থানাপুলিশের কতিপয় এসআই অভিযানের খবর মাদককারবারিদের আগেই জানিয়ে দিতেন। পুলিশের এসব কর্মকর্তা নিয়মিত নির্ধারিত হারে মাসোহারা নেন তাদের কাছ থেকে। আমাদের সময়ের দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
রাজধানীর অন্যতম বড় মাদক স্পট মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও মাথাব্যথার কারণ স্পটটি। গত বছর দেশব্যাপী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হলে জেনেভা ক্যাম্পেও নিয়মিত অভিযান চালায় র‌্যাব-পুলিশ; গ্রেপ্তার করা হয় চিহ্নিতসহ কয়েকশ মাদককারবারিকে। এতকিছুর পরও জেনেভা

ক্যাম্পে মাদকের কারবার নির্মূল করা যায়নি। ক্যাম্পের সাধারণ বাসিন্দারা বলছেন, মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানের ফলে ক্যাম্পে মাদকের বেচাকেনা আগের চেয়ে কমেছে। তবে বন্ধ হয়নি। এজন্য তারা পুলিশের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশকে দায়ী করছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে অনুসন্ধানে নেমে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য-প্রমাণ। মাদককারবারিদের সঙ্গে কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার অনৈতিক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক এবং অভিযানের খবর আগেভাবে মাদককারবারিদের জানিয়ে দেওয়ার চিত্র উঠে এসেছে দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে। এ সময়কালে বিভিন্ন কৌশলে বেশকিছু মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর থানার এসআই রাজীব মিয়া ও মাদককারবারি মনিরের একটি কথোপকথনের রেকর্ডের অংশ বিশেষ,

মনির : আসসালামু আলাইকুম। ভাই আমি তো সব সময় আপনার সাথে আছি। আমি কোন সময় আপনার সাথে নাই ভাই কন? এসআই রাজীব : আপনি ভদ্রলোক, ভালো লোক। ক্যাম্পে আপনার মতো ভালো লোক নাই। মনির : ভাই আমার ভাইরে একটু পাঠাই দেন। আপনি যা কইবেন আমি তাই করব ভাই। এসআই রাজীব : আমি এক ঘণ্টা খুঁজে ওয়ারেন্ট বের করলাম। এর মধ্যে যে দারোগা ধরছে সে মামলা দিয়ে চলে গেছে। এর মধ্যে আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে কি মনির ভাইর ভাই? মনির : আমি তো ভাই লোক পাঠাই রাখছি অনেক আগে। এসআই রাজীব : ও তো অনেক আগে আসছে কিন্তু আমাকে বলে নাই। বললেই হতো। আমি দেখতাম দৌড়ঝাঁপ করতাম। ও তো আমার কাছের ছোট ভাই। মনির : আপনি যা বললেন আমি তা-ই ব্যবস্থা করব ভাই। ওরে বাঁচান। ও তো এইডা করে না ভাই। এসআই রাজীব : হ্যাঁ আমি তো জানি ও করে না। আমি তো কিছু করি নাই। এখন নতুন নতুন অফিসাররা আসছে, এরা কথাও বোঝে না। উল্টাপাল্টা কাজ করে বসে থাকে। আমি কি আগে আপনার উপকার করিনি? মনির : হ্যাঁ ভাই আপনি আগে অনেক উপকার করছেন ভাই।

এসআই হাসানের সঙ্গে একই মাদক কারবারির আরেকটি ফোনোকথন,
মনির : আমার ভাই (মনিরের ভাই হীরা) ওর তো মামলা নাই। ওকে তো নিয়ে গেছে। একটু দেখেন ভাই। এসআই হাসান : ওর তো ওয়ারেন্ট আছে। মনির : না ভাই ওয়ারেন্ট নাই। এসআই হাসান : দেখি স্যারদের সাথে কথা বলে দেখি। মনির : দেখেন ভাই আর এ জন্য কি করতে হবে আমি করে দিবানি ভাই। এসআই হাসান : তোমার তো কথা ঠিক থাকে না। আচ্ছা আমি থানায় গিয়ে দেখি।
এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই হাসানুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, অভিযোগ সঠিক নয়। আর অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও এসআই রাজীবের ভাষ্য পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোহাম্মদপুর থানার এসআই আল আমিন, এসআই রাজীব, এসআই হাসানসহ অন্তত ৫ জন কর্মকর্তা প্রতি সপ্তাহে জেনেভা ক্যাম্পের প্রত্যেকে মাদককারবারির কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে মাসোহারা নেন। এ ছাড়া ক্যাম্প ও মোহাম্মদপুরের স্থানীয় প্রভাবশালীদেরও দিতে হতো মোটা অঙ্কের মাসোহারা। এর মধ্যে ক্যাম্পের এক কথিত নেতাও রয়েছেন মাসোহারা নেওয়ার তালিকায়।
মাদককারবারি মনির ও হীরার মা জোহরা বেগম বলেন, কিছুদিন আগে আমার ছেলেদের বোঝানোর পর তারা এখন মাদক কারবার ছেড়ে দিয়েছে। এর পর তিনি আমাদের সময়ের কাছে অভিযোগ করেন, কিন্তু কিছু প্রভাবশালী লোকের মাসোহারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা ফের মাদক কারবারে নামানোর জন্য আমার ছেলেদের চাপ দিচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেনেভা ক্যাম্পের একাধিক মাদককারবারি এ প্রতিবেদককে জানান, দারিদ্র্যের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিহারিদের মাদক ব্যবসায় যুক্ত করা হয়ে থাকে। আর মাদক ব্যবসার লাভের একটি বড় অংশই প্রভাবশালীদের দিতে হয়।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও অপর প্রান্তের সাড়া মেলেনি। এর পর যোগাযোগ করা হয় ডিএমপি তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব বিজয় তালুকদারের সঙ্গে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমি এখানে যোগ দিয়েছি সাত দিন হলো। আমাকে বরং আপনারা তথ্য দিয়ে সাহায্য করুন। পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পাঠকের মতামত: