বান্দরবান প্রতিনিধি ::: শুধু পাহাড়ধসের ঘটনা নয়, সামান্য বৃষ্টি হলেই বানের জলে ডুবে থাকছে বান্দরবান-চট্টগ্রাম ও বান্দরবান-কক্সবাজার সড়ক। এর ফলে সারাদেশের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পর্যটন অঞ্চল হিসেবে ক্রমশঃ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বান্দরবান জেলা। টানা ৪/৫ ঘন্টার বৃষ্টিতে ৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে বান্দরবান-রাঙামাটি সড়কের স্বর্ণমন্দির সংলগ্ন বেইলি ব্রিজ এবং বান্দরবান-রোয়াংছড়ি সড়কের ৪ কিলোমিটারে অবস্থিত বেইলি ব্রিজ। এর ফলে বিকল্প কোনো পথ ব্যবহার করে বান্দরবান যাতায়াত করার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। একই অবস্থা রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি এবং ঈদগড়-ঈদগা-বাইশারি সড়কেও। রাস্তায় ভাঙন, পানি জমে থাকা এবং খানা-খন্দকে এসব সড়ক যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা, পায়ে হেঁটে পার হওয়াও দায়।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নির্মিত বান্দরবান-রুমা সড়কটি পাহাড়ধসের কারণে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিলেও এই সড়কের ২২ কিলোমিটার পয়েন্টে ১৩ জুন, ৬ জুলাই এবং ২৩ জুলাই পর পর তিন বার পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। একই পয়েন্টে বারবার পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটলেও বিকল্প কোনো উপায় বা ধসপ্রবণ এলাকায় নিরাপত্তা বিধানে সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে প্রাণ হারিয়ে রুমা উপজেলা পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার জবিউল হোসেন, কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা গৌতম নন্দী, স্বাস্থ্য সহকারী মুন্নী বড়ুয়া, কিশোরী চিং মে হ্লা এবং চিং মে প্রু। প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছেন মিনঝিরি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চিত্ত রঞ্জন চাকমা, এনজিও কর্মী অং থোয়াই মারমা ও বাসের সহকারী রুবেল চাকমা।
বান্দরবান সড়ক বিভাগ জানায়, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ১৯৮৫-১৯৮৬ অর্থ বছরে ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হয়। বর্তমানে সড়কটির সংস্কার ও সম্প্রসারণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছে সেনাবাহিনীর ১৯ নং ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন (ইসিবি)। ফলে এই সড়কের ভালো-মন্দ কোনোটার দায়ই সড়ক বিভাগের নয়। অন্যদিকে ইসিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সড়কের বিভিন্ন অংশ সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ সফল হলেও দৌলিয়ান পাড়া সংলগ্ন ২২ কিলোমিটার পয়েন্টের পাহাড়ধসকে বাগে আনা যাচ্ছে না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৪৫ কিলোমিটারের এই সড়কে অসংখ্য ঝিরি থাকায় যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপনে ৬৬টি বেইলি সেতু ও অসংখ্য কালভার্ট নির্মাণ করতে হয়েছে। ওয়াই জংশন (১৯ কিলোমিটার) পয়েন্ট থেকে কৈক্ষং ঝিরি পর্যন্ত খাড়া পাহাড়ের ঢাল কেটে কেটে নির্মিত হয়েছে পুরো পথ। ফলে নির্মাণের পর থেকে সড়কটি আছে ‘অত্যধিক ঝুঁকি’র মধ্যে। অস্যংখ বাঁক থাকায় ৪৫ কিলোমিটারের এই সড়ক অতিক্রম করতে বাস-ট্রাক-জিপের আড়াই থেকে ৩ ঘন্টা লেগে যাচ্ছে।
’৯০ এর দশকে চিম্বুক পাহাড়ের পরের অংশ থেকে রাস্তা নির্মাণের মাধ্যমে থানচি উপজেলাকে সংযুক্ত করা হয়। ফলে থানচির পাথুরে নদী তিন্দু, বড় পাথর, রেমাক্রি ঝরনা, শঙ্খ নদীর উৎসমুখ আন্ধারমানিকসহ অপরাপর পর্যটন স্পটগুলো চলে আসে যোগাযোগ নেটওয়ার্কে। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক পর্যটক এই পথ ধরে বিভিন্ন যানবাহনে সেখানে যাচ্ছেন। গত ২৫ জুলাই ভোরে পাহাড়ধসে এই রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে যায়।
টানা ১০ বছরের অবিরাম চেষ্টার পর সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়নের তত্ত্বাবধানে ২০১৫ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হয় ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের সবচেয়ে উচ্চতার স্থলপথ থানচি-আলীকদম সড়ক। বর্তমানে সড়কের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক ভাঙন ও পাহাড়ধসের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সড়ক। সংস্কার করে আবার কবে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করা যাবে, তা বলতে পারছে না সড়ক ও জনপথ বিভাগ বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
১৯৮৬-১৯৮৭ সালে কক্সবাজারের চিরিঙ্গা থেকে লামা হয়ে আলীকদম পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন। একসময় অধিক কার্যকর থাকলেও বর্তমানে কয়েকটি পয়েন্টে পাহাড় ধসে প্রায়ই বন্ধ থাকে চিরিঙ্গা-লামা-আলীকদম সড়ক।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের খাতায় মধ্যম মানের ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ বান্দরবান-রোয়াংছড়ি সড়ক। এই সড়কের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে পাহাড়ধস এবং রামজাদি মন্দির সংলগ্ন বেইলি ব্রিজ, কলাতলী বেইলি ব্রিজ, খানসামাপাড়া বেইলি ব্রিজসহ কয়েকটি কালভার্ট ভেঙে গিয়ে প্রায়ই অচল থাকে স্বল্প দৈর্ঘ্যের এই সড়ক। সংস্কার না থাকায় রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি এবং ঈদগড়-ঈদগা-বাইশারি সড়কও ক্রমশঃ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠছে।
বান্দরবান সড়ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, এই জেলার প্রায় সব কটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মাণ ও সংস্কার কাজ চলছে।
এদিকে পর্যটন খাতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে বান্দরবান জেলা সদরের সাথে পর্যটন স্পটগুলোর সংযোগ সড়কগুলোকে নিরাপদ করা না হলে বান্দরবানে দেশি-বিদেশি পর্যটক আগমন হ্রাস পাবে। এতে স্থানীয় পর্যটন শিল্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে।
পাঠকের মতামত: