ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

বান্দরবানে ব্যাহত হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিশুদের পাঠদান

Bandarban-Child-PiC_01বান্দরবান প্রতিনিধি :::

মায়ের ভাষায় শিক্ষা, এটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের অনেকদিনের দাবি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গাষ্ঠীদের মধ্যে ৮টি নৃ-গাষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। আইনি অধিকার থাকার পরও নিজের মায়ের ভাষায় লেখাপড়া শেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে এসব শিশুরা। কিন’ চলতি বছর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের শিশুদের প্রাক প্রাথমিকে মাতৃভাষায় পড়াশোনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে শিক্ষক সংকট, পাঠ্যবই স্বল্পতা এবং পাঠদানের সময়সূচি সম্পর্কে কোনো সঠিক নির্দেশনা না থাকায় পাঠদানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
বান্দরবানের পাড়া প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উসংনু মারমা বলেন, আমার বিদ্যালয়ে মাত্র চার জন মারমা শিশু প্রাক-প্রাথমিকের ছাপানো পাঠ্যবই পেয়েছে। অন্য শিশুরা কখন বই পাবে তা জানি না। মাতৃভাষায় শিশুদের বই দেয়া হলেও শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। এছাড়া কোন সময়ে শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদান করানো হবে সে সর্ম্পকেও কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। যে কারণে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।
পাবলা হেডম্যানপাড়া কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র আদী ম্রো এবং চামলেন ম্রো বলেন, আমরা মায়ের ভাষায় লেখাপড়া শিখতে চাই। আমাদের ম্রো ভাষায় বই দরকার। সরকার আমাদের বই ছাপিয়ে দিলে আমরাও মাতৃভাষায় শিখতে পারবো। এটি সরকারের কাছে আমাদের দাবি।
অপরদিকে ২০০৬ সালে উন্নয়ন সংস’ার সহায়তায় বেসরকারি পর্যায়ে মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাক-প্রাথমিক স্কুল চালু হয়। তবে চলতি বছর থেকে সরকারিভাবেই প্রাক-প্রাথমিকে মাতৃভাষায় লেখাপড়া শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা এবং সমতলের গারো, সাওতাল এ পাঁচটি নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার পাঠ্যবই ছাপিয়েছে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম বোর্ড।
প্রতিটি ভাষার শিশুদের জন্য দুটি করে বই ছাপানো হয়েছে। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য, লেখক ও গবেষক সিইয়ং ম্রো বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা বাড়িতে মায়ের ভাষায় কথা বললেও স্কুলে গিয়ে শিশুদের বাধাঁর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। স্কুলে ভিন্ন ভাষায় লেখাপড়া শেখা কঠিন ঠেকছে পাহাড়ি শিশুদের। এসব শিশুরা বাংলা বোঝে না, তাই লেখাপড়ার প্রতি প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের আগ্রহ কম।
মায়ের ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ পেলে শিশুরা সহজে গ্রহণ করতে পারবে। কিন’ পাশাপাশি বাংলাসহ অন্যান্য ভাষাও থাকতে হবে।
তবে আমরা আশাবাদী সরকার যেহেতু পাঁচটি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যবই ছাপিয়ে মাতৃভাষায় শেখার উদ্যোগ নিয়েছে, তাই পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদেরও মায়ের ভাষায় লেখাপড়ার ব্যবস’া গ্রহণ কর উচিত।
খুমী লেখক ও গবেষক সিঅং খুমী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের মধ্যে আটটি জাতির নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। কিন’ খুমী শিশুরা বর্ণমালা থাকার পরও মায়ের ভাষায় লেখাপড়া শেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। সরকার পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতির মত অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদেরও মাতৃভাষায় পড়াশোনা শেখার উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মংনুচিং বলেন, সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৯২ সালে মাতৃভাষা শিক্ষা কোর্স চালু হয়। এর ধারাবাহিকতায় মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, বম, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, খুমী ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। অন্যান্য জাতিগুলোরও বর্ণমালা, ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষায় কাজ করছে সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট।
এদিকে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রিটন বড়-য়া জানান, জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখনো মাতৃভাষায় ছাপানো প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের পাঠ্যবইগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌছায়নি। তবে মারমা ভাষায় প্রায় আটশ বই পাওয়া গেছে।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৯২ সালে মাতৃভাষা শিক্ষা কোর্স কার্যক্রম চালু হয়। এর ধারাবাহিকতায় মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, বম, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, খুমী ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটগুলোতে। এছাড়াও খেয়াং, লুসাই, পাঙ্খোয়াসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব বর্ণমালা এবং ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা।
যার মধ্যে সাত উপজেলায় একশ করে সাতশ বই পাঠানো হয়েছে। মাতৃভাষায় লেখাপড়া শেখানোর জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বই স্বল্পতার কারণে স্কুলগুলোতে মাতৃভাষায় পাঠদান কার্যক্রম আজও চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে তা দ্রুত চালু করা হবে।

পাঠকের মতামত: