ঢাকা,সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের জলসীমায় বিদেশী নৌকার লাইসেন্স ক্ষতিকর

shipপ্রতীকী ছবি

খসড়া সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০১৬-এর সংশোধন প্রয়োজন

মো. মজিবুল হক মনির :

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪ সালে ভারত এবং ২০১২ সালে মায়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে জয়ী হয়ে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১১০০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় অধিকার লাভ করে। এখন সময় এই এই এলাকার সম্পদ আহরণ বা সদ্ব্যবহার করে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশের তালিকায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণের।

বিশাল এই সমুদ্র একটি সম্ভাবনা, কিন্তু যথাযথভাবে এর সংরক্ষণ না করা হলে তা আমাদের জন্য হুমকিও হয়ে যেতে পারে। এই এলাকায় নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠাকে মজবুত করতে হবে আগে। কিন্তু সম্প্রতি অনুমোদিত খসড়া সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০১৬-তে বাংলাদেশের সমুদ্র জলসীমায় বিদেশি জাহাজকে মৎস্য আহরণের সুযোগ অব্যহত রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৯৮৩ সালে তৎকালীন অগণতান্ত্রিক সরকার প্রণীত সামুদ্রিক মৎস্য অধ্যাদেশে বিদেশি জাহাজ বা নৌযানকে বাংলাদেশে জলসীমায় মৎস্য আহরণের লাইসেন্স প্রদানের সুযোগ ছিল। ৯০-এর পর গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে এই সুযোগ রহিত করার দাবি ছিল সংশ্লিষ্ট মহল থেকে। বর্তমান সরকারের কাছে এই দাবি এখন আরও প্রাসঙ্গিক। তাই আমরা মনে করি, দেশের জলসীমায় বিদেশি জাহাজের মৎস্য আহরণের জন্য লাইসেন্স প্রদানের যে বিধান খসড়া আইনে অব্যহত রাখা হয়েছে তা বাতিল করতে হবে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। দেশের মোট জিডিপিতে মৎস্য খাতের একক অবদান প্রায় ৪%, জিডিপিতে মোট কৃষিখাতের যে অবদান তার প্রায় ২৪% মৎস্য খাতের। দেশের মোট আমিষ চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগ পূরণ করে এই খাতটি এবং এতে প্রত্যক্ষভাবে জীবিকার জন্য নির্ভর করে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই খাতটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মোট প্রায় ২ কোটি মানুষ, এদের মধ্যে প্রায় ১০ ভাগই নারী। কিন্তু দেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৫৩ গ্রাম মাছ খায়, যেখানে খাওয়া উচিৎ ৬০ গ্রাম। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে সামুদ্রিক মৎস্য খাতের অবদান খুবই কম। মোট মৎস্য উৎপাদনের মাত্র শতকরা ১৬ভাগের মতো আসে সামুদ্রিক খাত থেকে। প্রায় ৫ লাখ লোক সামুদ্রিক মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় যে মৎস্য সম্পদ আছে তা কি দেশের চাহিদা পূরণে বা উপকূলীয় এলাকার যেসব মানুষ এই সম্পদের উপর নির্ভরশীল তাদের জন্য যথেষ্ট? এর কোনও সুনির্দিষ্ট উত্তর আসলে কারও জানা নেই। এর কারণ বঙ্গোপসাগরে কী পরিমাণ সম্পদ আছে প্রায় ১৮ বছর ধরে এর কোনও জরিপই নেই। গত ডিসেম্বরে এমভি মীন সন্ধানী নামের একটি জাহাজ জরিপ শুরু করেছে, যার ফল পেতে সময় লাগবে আরও ৩ বছরের মতো। সম্পদের উপর জরিপ না চালিয়েই বড় বড় মাছ ধরার জাহাজের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে মাছ ধরার বড় ট্রলার আছে ২২৫ টির মতো, যান্ত্রিক নৌযান আছে প্রায় ৬৮ হাজার। স্বাধীনতার পর ট্রলারের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০টি। কতটুকু সম্পদ আছে তার বৈজ্ঞানিক জরিপ ছাড়া মাছ ধরার ট্রলারের সংখ্যা বাড়ছে, জেলেদের সংখ্যা বাড়ছে, মাছের সংখ্যাও কমছে, যদি বিদেশি জাহাজের দৌরাত্মও বাড়ে তাহলে দেশের জেলেদের সংকট আরও তীব্র হওয়াই স্বাভাবিক।

সমুদ্র আইন সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদে বলা আছে যে, কোন দেশের মৎস্য সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকলে, সে তার জলসীমায় বিদেশি জাহাজকে মাছ ধরার অনুমোদন দিতে পারে। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমার মৎস্য সম্পদ দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না, তা ছাড়া এই সম্পদ উদ্বৃত্ত সম্পদ কিনা তারও কোনও বিজ্ঞান সম্মত জরিপ নেই, তাই বিদেশি জাহাজকে নিজের এলাকায় মাছ ধরার অনুমোদন প্রদানে বাংলাদেশ আইনত বাধ্য নয়।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে যারা সমুদ্রে মাছ ধরেন তাদের প্রায় ৮৭ ভাগই বিভিন্ন সনাতনী পদ্ধতিতে মাছ ধরে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা হয়ত মাছ ধরতে পারবেন না, কারণ বড় বড় ব্যবসায়ী, ট্রলার মালিক, বিদেশি জাহাজ আধুনিক নানা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাছ ধরে নিয়ে যাবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এই দেশের প্রান্তিক জেলেরা। প্রান্তিক জেলেরা দেশের বড় বড় ট্রলারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিকতে পারছেন না। ট্রলারগুলোর জন্য উপকূলের ৪০ মিটারের কম গভীর এলাকার মধ্যে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অনেক সময়ই তারা সেই নিষেধাজ্ঞা মানে না। ফলে এই এলাকার মাছের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে, আর যেহেতু ছোট নৌকার জেলেদের পক্ষে গভীর সমুদ্রে যাওয়া সম্ভব না, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে অনেক সময় বাধ্য হয়েই, জীবিকা নিশ্চিত করতে জেলেরা বিভিন্ন নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকর জাল ও পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছ ধরে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রান্তিক মৎস্য শ্রমিক বা জেলেরা, যারা উপকূলের আশপাশের ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। ফলে বিদেশি জাহাজ এলে সংকট আরও তীব্র হতে বাধ্য।

উপকূলীয় এলাকার জেলেদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ যে, পাশ্ববর্তী ভরত ও মায়ানমার থেকে অনুমোদনহীন অনেক আধুনিক জাহাজ প্রায়ই বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে পড়ে, অনেক ছোট ছোট মাছ ধরার ট্রলারও প্রায়ই বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ করে মাছ ধরে, জেলেদের মাছ ও মালপত্র লুটে নিয়ে যায়। অনেক সময় নৌবাহিনীর হাতে ধরাও পড়ে। অত্যাধুনিক এইসব বিদেশি জাহাজ প্রযুক্তির দিক থেকে বাংলাদেশি মাছ ধরার ট্রলারের চেয়ে এগিয়ে। ফলে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এদেশের জেলেরা।

বাংলাদেশের সমুদ্র সীমার সম্পদে অনেকেরই নজর রয়েছে। তাই মাছ মাছ ধরার লাইসেন্স নিয়ে যেসব যান এই দেশে ঢুকছে সেগুলোর উপর কড়া নজরদারি না করলে সেটা পুরো দেশের জন্যই বড় নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করতে পারে। বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশের এলাকায় খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান করতে পারে, সম্পদ চুরি করতে পারে, এমনকি নানা সামরিক উদ্দেশ্যও চরিতার্থ করতে পারে। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর।

দেশের জেলেরা নানা সমস্যায় পীড়িত। তাদের সমস্যা সমাধানে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা গেলে এই জেলেরা দেশের অর্থনীতিতে গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এই মুহূর্তে উপকূলীয় এলাকার জেলেরা যেসব সমস্যায় ভূগছেন তার কয়েকটি হলো:

উপকূলে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে জেলেরাই সবার আগে এবং সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হয়, কারণ তারাই সাধারণত সমুদ্রের সবচাইতে কাছাকাছি বসবাস করেন। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন তাদের জীবন জীবিকার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। ঘন ঘন সাইক্লোন, নিন্মচাপ সৃষ্টি হওয়ায় তারা আগের মতো সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে পারছেন না। সামুদ্রিক ঝড়ে অনেক জেলেকে প্রাণও হারাতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।

উপকূলের অনেক জেলেরই বছরের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কোনও কাজ থাকে না, নেই তেমন কোনও বিকল্প আয়ের উৎসও। ফলে অধিকাংশ সময়ই তাদেরকে মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সূদে ঋণ নিতে হয়, কিংবা অগ্রিম শ্রম বিক্রি করতে হয়। সম্প্রতি চাদপুরে মেঘনা নদী এলাকায় দুই মাসের জন্য মাছ ধরা নিষেধ করা হয়েছে। সরকারি হিসেবেই এই এলাকার মাছ ধরায় নিয়োজিত ৪৬৬৫৪ জন জেলের মধ্যে ৪১০৪২ জন প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে চাল পাবেন। বাদ পড়ে যাবেন প্রায় ৫ হাজার জেলে। এদের সংসার চালানো তখন খুব কঠিন হয়ে যায়। এই চক্র থেকে তারা কখনই বের হতে পারে না। উপকূলের জেলেদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

এছাড়াও, প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করার কারণে উপকূলের প্রান্তি জেলেরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য সেবাসহ নানা সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিত করে, দেশের উন্নয়নে তাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন এক্ষেত্রে বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ হতে হবে দেশের মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই। তাই দেশের জলসীমায় বিদেশি মাছ ধরার নৌকাকে মাছ ধরার অনুমোদনের বিষয়টি আপাতত ন্থগিত রাখাই হবে যুক্তিযুক্ত।

মো. মজিবুল হক মনির, বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের একজন সহকারি পরিচালক

 

পাঠকের মতামত: