ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

প্রশিক্ষিত ডুবুরি নেই সমুদ্রকন্যা কক্সবাজারে

দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় খালি হয় মায়ের বুক, সহসা মেলে না লাশও

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

সাগরপাড়ের জনপদ কক্সবাজার। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত এখানে। সীমান্তে রয়েছে সেন্টমার্টিনের মতো দ্বীপ। আরো আছে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপাঞ্চল। এসব এলাকায় প্রায়ই ঘটে দুর্যোগ-দুর্ঘটনা। কিন্তু এখানে প্রশিক্ষিত কোনো ডুবুরি নেই। চট্টগ্রাম থেকে ডুবুরি এনে লাশ উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে হয়।

কক্সবাজারের চকরিয়ায় একদিকে পার্বত্য অববাহিকায় বহমান মাতামুহুরী নদী, অপরদিকে সমুদ্র উপকূল। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে মাতামুহুরী নদীর দুই কূল উপচে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয় এবং লণ্ডভণ্ড করে দেয় পুরো চকরিয়াকে। ইতোপূর্বে এমন অনেক বন্যায় অসংখ্য প্রাণহানিও ঘটেছে।

একইসঙ্গে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে উপকূলের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের ঘটনাও ঘটে। এই অবস্থায় ভয়াবহ বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে কোথাও কোথাও ঘরের চালা পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকে। এতে প্রাণহানির ঝুঁকিও থাকে অত্যধিক। কিন্তু ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্তে একটি প্রাণকেও বাঁচানোর সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। কারণ এখানে নেই কোনো প্রশিক্ষিত ডুবুরি, নেই স্পিড বোটও। এসবের সহায়তায় দুর্যোগময় মুহূর্তে যাতে উদ্ধার অভিযান চালানো যায়।

সর্বশেষ ১৪ জুলাই বিকেলে ঘটে যাওয়া মাতামুহুরী ট্র্যাজেডিতে এই বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। সেদিন একসঙ্গে চকরিয়া গ্রামার স্কুলের ৫ শিক্ষার্থী তথা খুদে ফুটবলার আমিনুল হোসাইন এমশাদ, সাইয়্যিদ জাওয়াদ আর্ভি, তুর্ণ ভট্টাচার্য, ফরহাদ বিন শওকত ও মেহরাব হোসাইনের স্নান করতে নেমে সলিল সমাধি হলে তাদেরকে উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও স্থানীয় জনতা এখানে-ওখানে তল্লাশি শুরু করে। এসবে কোনো কাজ না দেওয়ায় জেলেরাই নেমে পড়ে জাল নিয়ে মাতামুহুরী নদীতে। মূলত তাদেরই জালে পর পর তিন শিক্ষার্থীর লাশ আটকা পড়লে তাদের উদ্ধার করা হয়। কিন্তু দুই শিক্ষার্থী সাইয়্যিদ জাওয়াদ আর্ভি ও তুর্ণ ভট্টাচার্যের লাশের কোন সন্ধানই মেলছে না। এজন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসনে তদবির শুরু করেন চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান। উদ্দেশ্য নিখোঁজ থাকা দুই শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধারে ডুবুরি দলকে চকরিয়ায় প্রেরণ করা। কিন্তু বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারেও প্রশিক্ষিত ডুবুরি দলের সদস্য নেই জানালে হতাশ হয়ে পড়েন তারা। এই অবস্থায় চট্টগ্রামে যোগাযোগ করা হয় ডুবুরি দলের জন্য। শেষপর্যন্ত চট্টগ্রামের এই ডুবুরি দলটি সীতাকুণ্ডের কুমিরা থেকে গাড়িযোগে চকরিয়ায় আসলে এদিন রাত সাড়ে এগারটা এবং বারোটার দিকে নিখোঁজ থাকা পর পর দুটি লাশ উদ্ধার করলে স্বস্তি ফিরে পান স্বজনেরা।

সেদিন মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর পরই দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে মাতামুহুরী নদীর চরে নেমে পড়েন জাফর আলম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এসিল্যান্ড, ওসি, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও।

এ প্রসঙ্গে চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলার মধ্যে চকরিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। এই উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে সর্বনাশা মাতামুহুরী নদী। আর পশ্চিম দিকে রয়েছে সমুদ্র উপকূল। প্রতিনিয়ত মাতামুহুরী নদীতে বিভিন্ন বয়সের মানুষের প্রাণহানি ঘটে আসছে। তাছাড়া প্রতিবছর বর্ষামৌসুমে একাধিকবার ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয় মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি উজানের পানিতে। একইভাবে সাগরে নিম্নচাপ এবং পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠলে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি হানা দেয় চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার উপকূলীয় অন্তত ১৩ ইউনিয়নের লোকালয়ে। এ সময় এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বেড়িবাঁধসহ গ্রামীণ অবকাঠামো। কিন্তু ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কোনো মানুষ পানিতে ডুবে গেলে তাকে উদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা থাকে না কোনো প্রশিক্ষিত ডুবুরি না থাকায়। এ কারণে সলিল সমাধি ঘটে তাদের। অনেক সময় তাদের লাশও পাওয়া যায় না।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রশিক্ষিত ডুবুরি না থাকায় গত ১৪ জুলাই মাতামুহুরী ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের। এখানে-ওখানে যোগাযোগ করেও কোনো প্রশিক্ষিত ডুবুরি না পাওয়ায় একসঙ্গে পাঁচটি তাজা প্রাণ হারাতে হয়েছে অভিভাবকদের। এর পরও আমি নিজের পকেটের টাকা খরচ করে চট্টগ্রাম থেকে ডুবুরি দলের সদস্যদের এনে নিখোঁজ থাকা দুই শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করতে সহায়তা দিই।’

জাফর আলম বলেন, ‘সেদিন জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেই জানতে পারি সমুদ্র জনপদ কক্সবাজারের মতো জেলায় নেই কোনো প্রশিক্ষিত ডুবুরি। এই তথ্য পাওয়ার পর রীতিমতো আমি অবাক হয়েছি। কারণ কক্সবাজারের মতো একটি পর্যটন জেলাতে প্রশিক্ষিত ডুবুরি থাকার কথা। কেননা অপার সম্ভাবনার এই জেলাতেই রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্রসৈকত। সেই সৈকতে বিভিন্ন সময়ে পর্যটকেরও প্রাণহানি হচ্ছে সমুদ্রস্নানে নেমে। তাছাড়া সীমান্তে রয়েছে সেন্টমার্টিনের মতো দ্বীপ। রয়েছে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপ। বর্তমান সরকারের আমলেই এখানে চলছে হাজার হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে কাজ করছে বিদেশিরা। তাই মফস্বল উপজেলা চকরিয়া বাদ দিলাম, কক্সবাজারের মতো জেলায় যে প্রশিক্ষিত একজন ডুবুরিও নেই তা একেবারেই হতাশার এবং উদ্বেগের বিষয়। আমি আশা করি অচিরেই কক্সবাজার জেলাতে প্রশিক্ষিত একদল ডুবুরি নিয়োগ দেবে সরকার। যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দুর্ঘটনার সময় উদ্ধার অভিযান চালাতে পারে তারা।’

এদিকে কক্সবাজারে প্রশিক্ষিত ডুবুরি না থাকায় গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলেছেন। অনেকেই প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, সাগর পাড়ের জনপদ কক্সবাজারে প্রশিক্ষিত কোনো ডুবুরি নেই! চট্টগ্রাম থেকে ডুবুরি এনে লাশ উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে হয়! এসব তথ্য যেন অবাক করার মতোই। আরো লেখেন, ছেলেগুলোকে (মাতামুহুরী ট্র্যাজেডিতে মারা যাওয়া পাঁচ শিক্ষার্থী) হয়তো বাঁচানো যেতো না। কিন্তু তিন-চার ঘণ্টা আগে তো পূর্ণাঙ্গ অভিযান শুরু করা যেত। মৃত্যুর পর লাশটা অন্তত দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা যাতে থাকে সেজন্য এখন থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে প্রশাসনকে।

চকরিয়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা জি এম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসে কোনো ডুবুরি দল থাকে না। শুধুমাত্র বিভাগীয় পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল থাকে। তবে জেলায় যদি একদল প্রশিক্ষিত ডুবুরি দল থাকতো তাহলে যেকোনো দুর্যোগময় মুহূর্তে উদ্ধার অভিযান চালানো সহজ হতো। এজন্য বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার কক্সবাজারের প্রতি। কেননা এখানে দেশি ছাড়াও বিদেশি পর্যটকেরা বেড়াতে আসেন সমুদ্র দর্শনে। এতে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটেছে ইতোপূর্বে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কক্সবাজারে ডুবুরি দল না থাকাতে মাতামুহুরী ট্র্যাজেডিতে দীর্ঘসময় ধরে লাশ উদ্ধারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে সকলকে। তাছাড়া সেদিন মাতামুহুরী নদীর যে স্থানে এসব শিক্ষার্থী ডুবে গিয়েছিল, সে স্থানে যথেষ্ট স্রোত ছিল এবং তা কুণ্ডলীর মতোই। এ কারণে একের পর এক শিক্ষার্থী সেখানে তলিয়ে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু তাদের লাশ উদ্ধারে ডুবুরি দলের প্রয়োজন হয়। তাই চট্টগ্রাম থেকে ডুবুরি দল এসেই সেই লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।’

এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কক্সবাজারের আট উপজেলার মধ্যে চকরিয়া উপজেলা খুবই দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। একদিকে মাতামুহুরী নদীতে ডুবে প্রতিনিয়ত প্রাণহানি এবং পশ্চিমের উপকূলে সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে মৃত্যুঝুঁকির সম্ভাবনা বেশি। তাই সবকিছুই বিবেচনায় নিয়ে এখানে ডুবুরি দল থাকা অত্যাবশ্যক বলে মনে করি।’

ইউএনও বলেন, ‘ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, এখানে প্রশিক্ষিত কয়েকজন ডুবুরি সদস্য দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত একটি আবেদনও অচিরেই জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে জমা দেওয়া হবে।’

পাঠকের মতামত: