ঢাকা,বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪

পাহাড়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় আসছে ‘মহাপরিকল্পনা’

pahar-7নিউজ   ডেস্ক :
ভূমি ধসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর পাহাড়ি এলাকা ঘিরে দুর্যোগ মোকাবেলায় মহাপরিকল্পনা নিতে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে আসছে সপ্তাহে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক ডেকেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়; বৃহস্পতিবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে বৈঠকের বিষয়টি অবহিতও করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এক মাসের মধ্যে পাহাড়ি এলাকা ঘিরে ক্ষয়ক্ষতি ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে প্রতিবেদন তৈরিতে ২১ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করা হয়েছে বলে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো শাহ কামাল।
তিনি বলেন, ভূমিধসের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা নিতে আগামী সপ্তাহে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক ডাকা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের শীর্ষ ব্যক্তি, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে ভূমিধসের প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সম্ভাব্য কারণগুলো চিহ্নিত করে পাহাড়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, পাদদেশের বসতি সরানো, কারিগরি বিষয়গুলো বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকারে রাখতে হবে কর্মপরিকল্পনায়। গত ১১ জুন ভারি বর্ষণে রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, খাগড়াছড়িতে পাহাড় ধসে দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়।এক দশকে পাহাড়ে এত প্রাণহাণি আর কখনও ঘটেনি। এর আগে ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে ১২৭ জনের মৃত্যু হয় পাহাড় ধসের কারণে। বর্ষা মৌসুমের আগেই পাহাড়ে এত ভারি বর্ষণের রেকর্ড নেই জানিয়ে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ২০০৪ সালেও একবার ভারী বর্ষণ হয়েছিল নিম্নচাপের প্রভাবে। তখন নিম্নচাপ উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে পরে দক্ষিণ-পশ্চিমে অগ্রসর হয়। কিন্তু এবার ঘটেছে উল্টোটা। সাগরে মৌসুমী নিম্নচাপটি উপকূলের এসে উত্তরপƒর্ব দিকে এগিয়ে দুর্বল হয়ে লঘুচাপে পরিণত হয়েছে রাঙামাটিসহ পাহাড়ি এলাকায়। জলবায়ু পরিবর্তানের বিরূপ প্রভাবে আগামীতে এ ধরনের ঘটনা বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পাহাড় ও গাছ কাটা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার।
তিনি বলেন, “বর্ষায় কোনো না কোনো সময় ভারি বর্ষণ হবেই। তবে তার সঙ্গে পাহাড় কাটা, বনের গাছপালা কেটে ফেলার ঘটনা যোগ হলেই এর খেসারত দিতে হবে জানমালে।” পাহাড়ে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং অংশীজনের মতামত নিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দেন সমরেন্দ্র। ২০০৭ সালের ভূমিধসের পর এবারের পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি থাকা উচিত ছিল বলেও মন্তব্য করেন এ আবহাওয়াবিদ।
তিনি বলেন, “দশ বছর আগে চট্টগ্রামে প্রাণহানি ঘটেছিল। এবার পাহাড়ি এলাকায় ঘটেছে। এটা দৈবাৎ, দুর্যোগ মোকাবেলায়, পাহাড়ের দুর্যোগ মোকাবেলায় এখন সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে।” অতীতের তথ্য বিশ্লেষণে পাহাড়ে অতি ভারি বর্ষণের রেকর্ড সাধারণত জুন থেকে অগাস্টে হতে দেখা গেলেও পরিবেশগত পরিবর্তন বেড়ে যাওয়ায় ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট-আইডব্লিউএফএমর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মোহন কুমার দাস। বিলুপ্ত সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র-এসএমআরসির এই গবেষক বলেন, “পরিবেশগত ডিগ্রেডেশন বেড়ে যাওয়ায় অবিরাম বর্ষণের প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ঘটছে ভূমিধস। অপরিকল্পিত বসতি থাকায় প্রাণহানি বেড়েছে।”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো রিয়াজ আহমেদ বলছেন, ভূমিধসের দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা অনুযায়ী সব ধরনের কার্যক্রম তারা নিয়েছেন।
“অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামীতে বড় কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়ে আমরা কাজ করব, যাতে সবার অংশগ্রহণ ও বাস্তবায়ন দ্রুতভাবে করা যায়।” ইতোমধ্যে বিদ্যমান পরিস্থিতি সামলে নিতেও সমন্বিত কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম শহর এলাকায় ভারি বর্ষণে ব্যাপক প্রাণহানির পর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি কমিটি করা হয়েছিল জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বলেন, “তাদের কিছু সুপারিশ নিয়ে কাজ করা হয়েছে। কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূমিধসে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। এ অবস্থায় আমরা আগামীর প্রস্তুতি নিয়ে মহাপরিকল্পনা করার চেষ্টা নিয়েছি।” পরিবেশগত পরিস্থিতি, পূর্বাভাস ও প্রশাসনিক কাজ বাস্তবায়নে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা চাই, পাহাড় যেন নিজের মত থাকতে পারে। কারো যেন হস্তক্ষেপ না থাকে- সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।”
পাহাড় ধসে প্রাণহানি : ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের সাতটি স্থানে মাটিচাপায় ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালের ১৮ অগাস্ট চট্টগ্রামের লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে ২৬-২৭ জুন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও সিলেটে ৯৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৫ সালের ২৬-২৭ জুন টানা বর্ষণ, ধস আর পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে ১৯ জনের মৃত্যু হয়।
২০০৭ সালের কমিটি চিহ্নিত সমস্যা ও সুপারিশ : চট্টগ্রাম নগরীতে ২০০৭ সালের ভূমিধসের পর গঠিত কমিটি অন্তত দুই ডজন সমস্যা চিহ্নিত করে। ভারি বর্ষণ, পাহাড়ের মাটিতে বালির ভাগ বেশি থাকা উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস, পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটি অপসারণের দুর্বলতা এর মধ্যে অন্যতম। এর প্রেক্ষিতে পাহাড়ের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে আবাসিক প্রকল্প গড়ে না তোলা, পাহাড়ে জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন, ঢালু পাহাড়ে গাইডওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন বন্ধ করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এবার ভূমিধসের পর সমস্যা চিহ্নিত ও করণীয় নির্ধারণে গঠিত ২১ সদস্যের কমিটির প্রধান করা হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহাকে।
মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বলেন, কমিটি সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে সরেজমিন পরিদর্শন করে ‘ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণ’ বিষয়ে এক মাসের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেবে। পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখার স্বার্থে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানান কমিটির প্রধান সত্যব্রত সাহা।
তিনি বলেন, “পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন, গাছপালা কেটে পাহাড় ন্যাড়া করা, যত্রতত্র বসতি স্থাপন ও পুনর্বাসন, ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল, ভূমিধসপ্রবণ পয়েন্ট চিহ্নিত করাসহ সমস্যা সমাধানে সবার সঙ্গে কথা বলে যত দ্রুত সম্ভব প্রতিবেদন উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা রয়েছে আমাদের।”

পাঠকের মতামত: