ঢাকা,শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

নির্মিত হচ্ছে ভারতের সর্ববৃহৎ আটককেন্দ্র, আতঙ্কিত মুসলিমরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :: আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলায় নির্মিত হচ্ছে ভারতের সর্ববৃহৎ আটককেন্দ্র। দেশজুড়ে জাতীয় নাগরিক তালিকার (এনআরসি) ঘোষণা আর সদ্য সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) প্রেক্ষাপটে বিশাল আয়তনের এই আটককেন্দ্র নির্মাণের পদক্ষেপ মুসলিমদের মধ্যে তীব্র আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। কেননা আসামের এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলিম। সিএএ-তেও উপেক্ষিত তাদের প্রশ্ন।

আসামের নির্মানাধীন আটককেন্দ্রে কাজ করছেন ২৫ বছর বয়সী ইলেক্ট্রিশিয়ান আলী। কাজের ফাঁকে সেখানকার হাসপাতাল ব্লকের সামনে বিশ্রাম নিতে বসে তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। ‘আজ আমি এখানে কাজ করছি। কাল হয়তো এখানেই বন্দি হবে আমার বোন জামাই। বোনের পরিবারটা শেষ হয়ে যাবে’, বলেন তিনি।

গত বছর আসামে প্রকাশ হওয়া জাতীয় নাগরিক তালিকায় (এনআরসি) অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি আলীর বোন জামাই। ওই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৯ লাখ বাসিন্দা। আপাতত ‘অবৈধ অভিবাসী’ হয়ে পড়া এসব বাসিন্দাদের গন্তব্য হবে গোয়ালপাড়ার মতো আটককেন্দ্রগুলো। নয়তো তাদের প্রত্যর্পণ করা হবে।

আসামের রাজধানী দিসপুর থেকে ১২৬ কিলোমিটার দূরে গোয়ালপাড়ার মাটিয়া গ্রামে গড়ে তোলা হচ্ছে কেন্দ্রটি। তিন লাখ বর্গফুট (২৮ হাজার বর্গফুট বা ২.৮ হেক্টর) জায়গা জুড়ে নির্মিত এই ভবনের ধারণ ক্ষমতা তিন হাজার মানুষ। গোয়ালপাড়ার প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত এই সেন্টারটির তিন দিকে বিস্তৃত খোলা জমি আর বাম দিকের একটি সড়ক রাজ্যের মূল শহর গুয়াহাটির সঙ্গে সংযুক্ত।

সংযোগ সড়কটির একদিক চলে গেছে ‘ভূত’ পর্বতের মধ্য দিয়ে। জনচলতি বিশ্বাস অনুযায়ী কয়েক শতাব্দী আগে ওই পর্বত এলাকা শাসন করতো ভূতেরা। ফলে কোনও মানুষ তা পাড়ি দিতে পারে না। ‘আমার কাছে এখানেও একই পরিস্থিতি মনে হচ্ছে। যে মানুষ এই আটককেন্দ্রে যাবে সে আর ফিরে আসবে না’, বলেন স্থানীয় বাসিন্দা গুলাম নবী। সেখানকার বড় বড় দেয়ালের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘জনবসতি থেকে, পরিবার থেকে এক জন মানুষকে আলাদা করে ফেলে তাকে এই বিশাল দেয়ালের মধ্যে রেখে দেওয়া কি মানবিক?’

হাসপাতাল ছাড়াও সেন্টারটিতে থাকবে খাবার জায়গা, স্কুল, বিনোদন কেন্দ্র এবং পুরুষ ও নারী বন্দিদের জন্য আলাদা থাকার জায়গা। এটি নির্মাণকাজ তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন আসাম পুলিশের আবাসন বোর্ডের প্রকৌশলী রবীন্দ্র দাস। তিনি জানান, ‘ছয় ফুট উঁচু লাল রঙের দেওয়াল দিয়ে আলাদা করা পৃথক জায়গায় থাকবে নারী ও পুরুষ বন্দিরা’। তিনি বলেন ‘পুরো কম্পাউন্ডটি দুটি দেওয়াল দিয়ে ঘেরা থাকবে। একটি ২০ ফুট উঁচু আর অপরটি ছয় ফুট।’ নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে ছয়টি টাওয়ার থেকে সেন্টারটি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হবে। তাতে সহায়তা দেবে একশো মিটার উঁচু বিম লাইট।

নির্মাণস্থলের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সেন্টারটি নির্মাণে গত বছরের জুনে বরাদ্দ দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ডিসেম্বরে কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। রবীন্দ্র দাস বলেন, ‘এটা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প। এপ্রিলের মধ্যে আমাদের পুরো কাজ শেষ করতে হবে’।

ভারতের অন্য ডিটেনশন সেন্টারগুলো

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এখন পর্যন্ত দেশব্যাপী এনআরসি করার ঘোষণা দেয়নি। তা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হচ্ছে বেশ কয়েকটি ডিটেনশন সেন্টার। চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাভাষী অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রত্যক্ষ করা আসাম রাজ্যে ইতোমধ্যে চালু রয়েছে অন্তত ছয়টি ডিটেনশন সেন্টার।

গত ৩ ডিসেম্বর (২০১৯) ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিশান রেড্ডি পার্লামেন্টে এক লিখিত প্রশ্নের জবাবে জানান, গোয়ালপাড়ার ডিটেনশন সেন্টারে বর্তমানে ২০১ জন বন্দি রয়েছেন। আর কোকরাঝড়ে ১৪০ জন, শিলচরে ৭১ জন, দিবরুগড়ে ৪০ জন, জোরহাটে ১৯৬ জন ও তেজপুর সেন্টারে রয়েছে ৩২২জন। ২০০৮ সাল থেকে এসব সেন্টারে প্রায় একশো জন মারা গেছেন। এদের অনেকেই আত্মহত্যা করেছেন।

গত জুলাইতে আরেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায় বলেন, সব রাজ্যকেই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তুত করা মডেল ডিটেনশন সেন্টার ম্যানুয়ালের আলোকে ডিটেনশন সেন্টার স্থাপন করতে বলা হয়েছে। গত ২২ ডিসেম্বর দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্নাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরু থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে নিলামঙ্গলাতে অনিবন্ধিত শরণার্থীদের একটি সেন্টার চালু করা হয়েছে। ছয় রুমের একটি সরকারি ভবনে রান্নাঘর ও নিরাপত্তা কক্ষ মিলিয়ে সেন্টারটিতে ২৪ জন বন্দি থাকতে পারবে। সম্প্রতি দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও একটি সীমানা দেওয়াল যোগ করে সেখানে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।

গত বছরের ২৯ মে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গোয়াতে প্রথমবারের মতো ডিটেনশন সেন্টার চালু করেছে। আর রাজস্থানে কেন্দ্রীয় সরকারের কারাগারের অভ্যন্তরে রয়েছে একটি ডিটেনশন সেন্টার। এই বছরের মে মাসে পাঞ্জাবেও একটি সেন্টার নির্মাণ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় রাজধানী দিল্লিতে ডিটেনশন সেন্টার চালু রয়েছে ২০০৬ সাল থেকে। বিদেশি নিবন্ধনের আঞ্চলিক কার্যালয় (এফআরআরও) এই সেন্টারটি পরিচালনা করে।

পশ্চিমাঞ্চলীয় আরেক রাজ্য মহারাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কেন্দ্র মুম্বাইয়ের বাইরে ডিটেনশন সেন্টার নির্মাণের জমি বাছাই করে পূর্ববর্তী বিজেপি সরকার। তবে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে রাজ্যের মুসলমানদের ভীত না হতে আশ্বস্ত করেছেন। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসসহ কয়েকটি দলকে নিয়ে গঠিত জোট সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া ঠাকরে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তার সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের ডিটেনশন সেন্টার স্থাপনের আদেশ মানবে না।

ডিটেনশন সেন্টার স্থাপনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারও দুটি স্থান নির্বাচন করেছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। এর একটি রাজধানী কলকাতার কাছে আর অপরটি উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কঠোর সমালোচক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় গত সপ্তাহে বলেছেন, ‘গুজবে বিভ্রান্ত হবেন না। আমি জীবন দেবো তবুও বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে ডিটেনশন ক্যাম্প বানাতে দেবো না।’ বামপন্থী জোট শাসিত ভারতের আরেক রাজ্য কেরালাও প্রস্তাবিত ডিটেনশন সেন্টারের জন্য জমি নির্বাচন স্থগিত করে রেখেছে।

আনুষ্ঠানিক কোনও তথ্য না থাকলেও ভারতের ক্ষমতাধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এক নির্বাচনি মিছিলে দাবি করেন দেশে প্রায় ৪০ লাখ অনিবন্ধিত শরণার্থী রয়েছে।

মুসলমানদের শঙ্কা দেশজুড়ে এনআরসি

ইউনাইটেড অ্যাগেইনিস্ট হেট গ্রুপের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী এনআরসি থেকে বাদ পড়া ১৯ লাখ বাসিন্দার প্রায় অর্ধেকই মুসলমান। এখন ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের আশঙ্কা দেশব্যাপী এনআরসি প্রক্রিয়া চালু করবে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার। গত মাসে সিএএ পাসের পর ওই ভয় তীব্র হয়েছে। আর তা থেকেই দেশব্যাপী হয়েছে তুমুল বিক্ষোভ। এতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ২৬ জন।

সিএএ অনুযায়ী ২০১৫ সালের আগে প্রতিবেশি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যাওয়া মুসলমান বাদে ছয়টি ধর্মাবল্বী মানুষদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এই আইনটি নাগরিকত্বের শর্ত হিসেবে ধর্ম নির্ধারণ করে ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধানের লঙ্ঘন করেছে। অন্যদিকে মুসলমানদের আশঙ্কা সিএএ হচ্ছে এনআরসির আগের ধাপ। যাতে করে তাদের নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে।

বিজেপি’র মুখপাত্র সামবিত পত্র আল জাজিরাকে বলেছেন, আটককেন্দ্র স্থাপন আর এনআরসি’র মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের সঙ্গে এটাকে মেলাবেন না। আটককেন্দ্র অবৈধভাবে ভারতে থাকা বিদেশিদের জন্য।’ তবে এতে আশ্বস্ত নন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক তানভির ফজল। তিনি বলেন, ‘খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, অমুসলিমেরা যদি এনআরসি থেকে বাদ পড়ে তাহলে সিএএ তাদের রক্ষা করবে। ফলে আটককেন্দ্রে যাওয়ার বাকি থাকবে শুধুমাত্র মুসলমানেরা।’

পাঠকের মতামত: