ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

চালের দাম লাগামহীন।। মূল্য বৃদ্ধিতে আমদানি শুল্কের প্রভাব

riceজাহেদুল কবির ::

সরবরাহ সংকট না থাকলেও চট্টগ্রামে এখনো চালের বাজার উর্ধ্বমুখী রয়েছে। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে হিলি স্থল বন্দর দিয়ে কিছু পরিমাণ ভারতীয় চাল আমদানি হচ্ছে। ফলে দুই ক্যাটাগরির দেশীয় চালের মূল্য বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। তবে আরোপিত ২৫ শতাংশ আমাদানি শুল্ক ও ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করা না হলে চালের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই বলছেন ব্যবসায়ীরা। শুল্ক প্রত্যাহার করা হলে কেজি প্রতি চালের দাম কমবে ৭ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত। তবে মিল মালিকরা বলছেন, উচ্চ শুল্কায়নের পাশাপাশি হাওরে অকাল বন্যায় প্রচুর ফসলি জমি তলিয়ে যায়। হাওড় অঞ্চল থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান সরবরাহ না হওয়ায় সেটির প্রভাবও পড়েছে বাজারে। গত চার মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলীতে চালের মানভেদে বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা। বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিমত, ধান মজুদ করে মিল মালিকরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অনেক সময় দাম বাড়িয়ে নেয়। এছাড়া উচ্চ শুল্কায়নের প্রভাবে ব্যক্তি উদ্যোগে আশানুরূপ চাল আমদানি হচ্ছে না। কারণ হঠাৎ সরকার শুল্ক প্রত্যাহার করে নিলে লোকসানের মুখে পড়বেন আমদানিকারকরা। এছাড়া শুল্ক প্রত্যাহার নিয়ে সরকারের বর্তমান অবস্থান নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন চাল আড়তদাররা।

নগরীর বৃহৎত্তম পাইকারি চালের আড়ত খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই ও পাহাড়তলী ঘুরে দেখা গেছে, নাজিরশাইল, জিরাশাইল (সিদ্ধ), মিনিকেট (সিদ্ধ), বাসমতি (সিদ্ধ), স্বর্ণা (সিদ্ধ) বেতি, পাইজাম (আতপ), মিনিকেট (আতপ), কাটারি ভোগ (আতপ), চিনিগুড়া, ইরি চালের দাম গত চার মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা। এছাড়া মোটা সিদ্ধ চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি প্রায় ৭০০ টাকা। এসব চালের একটি বড় অংশই আসে আশুগঞ্জ, নেত্রকোনা, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, খুলনাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত মার্চ মাসে জিরাশাইল (সিদ্ধ) চালের পাইকারি দাম ছিলো বস্তাপ্রতি ২১শ টাকা বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৫০ টাকা (কেজিতে ৪৯ টাকা)। স্বর্ণা (সিদ্ধ) পূর্বের মূল্য ছিলো ২১শ টাকা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪শ টাকায় (কেজি ৪৮ টাকা)। মিনিকেট (সিদ্ধ) বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৪শ টাকায় (কেজি ৪৮ টাকা)। দেশি পাইজাম (আতপ) বস্তাপ্রতি ২৪৮০ টাকা অপরিবর্তিত রয়েছে। এছাড়া মিনিকেট (আতপ) বস্তাপ্রতি ৫০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৬শ টাকা (কেজি ৫২)। আতপ বেতি ৩০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২২শ টাকায় (কেজি ৪৪ টাকা)। দিনাজপুরী পাইজাম ৩৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৩শ টাকায় (কেজি ৪৬ টাকা)। এছাড়া কাটারি ভোগ (আতপ) ৬০০ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮শ টাকা (কেজি ৫৬ টাকা), মোটা সিদ্ধ চালের দাম ৭০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৮০০ টাকা (কেজি ৩৬ টাকা)। তবে বাজারে গত এক সপ্তাহ ধরে ভারতের হিলি স্থলবন্দর হয়ে স্বর্ণা (সিদ্ধ) ও বেতি আতপ চাল আমদানি হচ্ছে। ফলে দেশীয় দিনাজপুরী পাইজাম ও বেতি আতপের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।

এছাড়া নগরীর দামপাড়া, কাজীর দেউড়ি ও পাহাড়তলীর খুচরা ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি কেজি স্বর্ণা সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা, মিনিকেট (আতপ) এক নম্বর ৫৭ টাকা, জিরাশাইল (নবান্ন) ৫২ টাকা, আতপ বেতি এক নম্বর ৪৮ টাকা, দেশি পাইজাম ৪৭ টাকা, দিনাজপুরী পাইজাম ৫০ টাকা, কাটারিভোগ ৬০ টাকা, বেতি আতপ চিকন ৪৭ টাকা, সিদ্ধ জিরাশাইল চিকন ৫০ টাকা, সিদ্ধ মিনিকেট ৫২ টাকা ও মোটা সিদ্ধ চাল ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের আড়তদাররা অভিযোগ করে বলেন, মিলা মালিকেরা ধান সরবরাহে সংকট দেখিয়ে চালের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। এখন যে ধান রয়েছে তার সবই মিলারদের হাতে। এ সুযোগে তারা তাদের ইচ্ছামতো চালের দাম নির্ধারণ করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রাইচ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শান্ত দাশগুপ্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় উৎপাদিত ধান বিভিন্ন জেলার চাহিদা মিটায়। এবার হাওড় অঞ্চলে বন্যার কারণে কৃষক ফসল তুলতে পারেনি। মজুদ করে রাখার মতো এবার ধান উৎপাদন হয়নি। তবে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ধান মজুদ করেনি এমনটাও বলা যাবে না। আমদানি শুল্ক হার ২৮ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করলেও চালের দাম বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা কমবে।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের আড়তদার মাহবুবুল আলম বলেন, চাল আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে আমদানির সুযোগ দিতে সরকারের কাছে দাবি করছি। হাওড়ের ফসল ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে চাল আমদানির কোনো বিকল্প নেই। আমরা সামান্য মুনাফার বিনিময়ে মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল এনে বিক্রি করি।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ চাউল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. এনামুল হক বলেন, আমদানি শুল্কের প্রভাবে চালের দাম কেজি প্রতি ৭ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। হাওড়ে ফসলহানির পরপরই সরকারের উচিত ছিল শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়া। এখনো সময় আছে, কালকেও যদি শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়া হয় তাহলে চালের বাজার আবারও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।

কনজ্যুমাার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন জানান, চালের সংকট দীর্ঘদিনের। যদিও সরকার থেকে সব সময় বলা হচ্ছে চালের যথেষ্ট পরিমান মজুদ আছে, কিন্তু বাস্তবে কখনো সেটি প্রতীয়মান হয়নি। যত দ্রুত সম্ভব আমদানি শুল্ক কমিয়ে ব্যাক্তি উদ্যোগে আমদানির সুযোগ করে দেয়া দরকার। সরকারের পক্ষ থেকেও যে চাল আমদানি হচ্ছে সেটিও দেখা যাচ্ছে না।

পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম নিজাম উদ্দিন বলেন, বর্তমানে বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। হাওড় অঞ্চলে ফসলহানির পরে খাদ্য বিভাগ ধান-চাল সংগ্রহের ঘোষণার পর থেকে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠে। সরকার মিল মালিকদের কাছ থেকে ৩৪ টাকায় চাল ও ২৪ টাকায় ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ সেই সময় অনেক কৃষক ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। মূলত এর পিছনে কিছু সক্রিয় সিন্ডিকেট কাজ করেছে। এসব ব্যাপারে সরকারের কড়া নজরদারি প্রয়োজন।

জানা গেছে, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ এই দুই অর্থবছরে দেশে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে চাল আমদানি হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখ টন। ফলে এই সময়ে দেশে চালের দাম ছিল ২৫ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে। এছাড়া আমদানি শুল্ক বাড়ানোর ফলে গত এক বছর আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২৮ হাজার টন। যার ফলে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী।

পাঠকের মতামত: