তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার :: মেরিন ড্রাইভ। কক্সবাজার থেকে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গাছের ছায়ায় সড়কটি চলে গেছে টেকনাফ পর্যন্ত। এ সড়কে গাড়ি উঠলে মানুষের মন তার সঙ্গে ছুটে চলা পাশের নীল সাগরের ঢেউয়ের মতো উচ্ছল হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্পের ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, রীতিমতো ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বাস্তবায়ন করেছে। ২০১৭ সালের ৬ মে প্রধানমন্ত্রী মেরিন ড্রাইভ সড়কের ইনানী সৈকত পরিদর্শন করে এক জনসভায় বলেছিলেন, মেরিন ড্রাইভ পর্যটনের নতুন দুয়ার খুলে দেবে।
সেই স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ কিছুদিনের মধ্যে পরিণত হয় আতঙ্কের ‘ক্রসফায়ারের’ নিরাপদ এলাকা হিসেবে। পুলিশ ও র্যাবের হাতে মেরিন ড্রাইভে এত ব্যাপক হারে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে যে মেরিন ড্রাইভ এখন যেন ‘রোড টু ডেথ’-এর সমার্থক হয়ে উঠেছে। গত দুই বছরে শুধু মেরিন ড্রাইভেই অর্ধশতাধিক ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে।
কক্সবাজার এলাকায় এখন কেউ কাউকে হুমকি দিতেও ‘মেরিন ড্রাইভ দেখিয়ে দেওয়ার’ কথা বলে। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ চালু করেন মেরিন ড্রাইভে ‘ক্রসফায়ারের’ ব্যাপক প্রচলন। অবশ্য এর আগে ২০১৭ সালে টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামের ‘ক্রসফায়ারে’ মৃত্যুর ঘটনাটিও মেরিন ড্রাইভে ঘটেছিল।
সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত মেরিন ড্রাইভে সর্বশেষ কয়েক দিন আগে পুলিশের সরাসরি গুলিতে লুটিয়ে পড়েন সেনাবাহিনীরই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
শুরুর দিকে বড় বড় অপরাধী ও মাদক কারবারিরা ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ায় সাধারণ মানুষ কিছুটা অনুমোদনের মানসিকতায় বিষয়টি দেখেছে। কয়েক বছর ধরে মানুষের মনে ভয়ের কাঁপন ধরিয়েছে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি। পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের টাকার চাহিদা মেটাতে না পেরে অনেকের জীবনও গেছে—এমন অভিযোগও আছে।
টেকনাফের সীমান্ত এলাকায় ইয়াবা বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরুর আগে থানার কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেই ইয়াবা কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ ছিল। চলছিল ‘গ্রেপ্তার বাণিজ্য।’ রাতবিরাতে ইয়াবা কারবারের অভিযোগ তুলে লোকজনকে আটক করে থানায় আনা হতো। এরপর তাদের ইয়াবার পুঁটলি দেখিয়ে চালান দেওয়ার নামে আদায় করা হতো টাকা। পুলিশের সেই গ্রেপ্তার বাণিজ্য নিয়ে ২০১৭ সালের ৭ জুলাই কালের কণ্ঠে ‘টেকনাফ পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য’ শীর্ষক অসাধু পুলিশ সদস্যের ইয়াবা কানেকশন সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এক সপ্তাহের মধ্যেই সাত পুলিশ সদস্যকে একযোগে অন্যত্র বদলি করা হয়েছিল।
ইয়াবা কারবারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ইতিবাচক অভিযান চলার পর টেকনাফে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের স্থলে জায়গা নেয় লোমহর্ষক ‘ক্রসফায়ার বাণিজ্য’। এতে কৌশলেরও রদবদল হয়েছে। যেমন—এখন প্রকাশ্যে কোনো পুলিশ সদস্যকে মাসোহারা আদায়ের কাজে লাগানো হয় না। পথেঘাটে কোনো পুলিশ সদস্য চাঁদাবাজিতে নেই। কিন্তু ভেতরে চলছে ভয়ংকর কারবার। অভিযোগ উঠেছে, যারা ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার হয়, মৃত্যুর আগে তাদের কাছ থেকেও বিপুল চাঁদা আদায় করা হয়।
গত ২৪ জুলাই উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক ইয়াবা গডফাদার মৌলভি বখতিয়ার নামের একজন ইউপি সদস্যকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ নিজেই অভিযান চালিয়ে মৌলভি বখতিয়ারসহ তাহের নামের আরো একজন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেন ওই রাতে। এক দিন পর দুজনের ভাগ্যে জোটে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়, মৌলভি বখতিয়ারের ঘর থেকে ১০ লাখ নগদ টাকা এবং ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।
জানা গেছে, ঘটনার পর একটি বিশেষ সংস্থার কাছে দেওয়া জবানিতে নিহত মৌলভি বখতিয়ারের স্ত্রী জানিয়েছেন, সেই রাতে ওসি প্রদীপ কুমারের নেতৃত্বে পুলিশি অভিযানে নগদ ৫১ লাখ টাকা ও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মৌলভি বখতিয়ারের এক ছেলেকে ডেকে নিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় আরো বিপুল অঙ্কের টাকা।
অভিযোগে বলা হয়েছে, টেকনাফের হোয়াইক্যং ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সহসভাপতি মুফিদ আলমকে ক্রসফায়ারের নামে ধরে নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করা হয়। একই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাকের আলমকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় ২০০টি ইয়াবা দিয়ে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আজিম ও মোহাম্মদ জুবায়েরকে দ্বীপের পুলিশ ঈদুল আজহার তিন দিন আগে আটক করে ইয়াবা কারবারের অভিযোগে। তাঁদের দ্বীপ থেকে চালান করা হয় টেকনাফ থানায়। অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। আটক হওয়া আজিমকে লেনদেনের মাধ্যমে ক্রসফায়ার থেকে রেহাই দিয়ে চার হাজার ইয়াবা দিয়ে চালান দেওয়া হয় আদালতে। আর জুবায়েরকে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হয় চাহিদামাফিক টাকার জন্য।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুধু টেকনাফেই গত ২২ মাসে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের হাতে ১৪৪টি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মারা গেছে ২০৪ ব্যক্তি। তাদর অর্ধেকের লাশ পড়ে মেরিন ড্রাইভে।
২০১৭ সালের অক্টোবরে টেকনাফে ব্যবসায়ীদের করা অভিযোগের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ১৭ লাখ টাকাসহ গোয়েন্দা পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্যকে আটক করার পর তা নিয়ে তোলপাড় হয়। এর আগে ২০১৭ সালের জুনে টেকনাফের একটি গ্রামের আওয়ামী লীগের এক তৃণমূল কর্মী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগের তদন্তের পর টেকনাফ থেকে আট পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়েছিল।
ইয়াবাসহ মাদক পকেটে ঢুকিয়ে হয়রানির বিস্তর অভিযোগ :
যশোরের কলেজছাত্র ইমরান হোসেন। গত ৩ জুন যশোর সদর উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের নেছার আলীর ছেলে ইমরানকে সাজিয়ালি ফাঁড়ির পুলিশ আটক করে নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে ইমরানের কিডনি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। এ অবস্থায় পুলিশ অভিযোগ করে, গাঁজাসহ ইমরানকে আটক করা হয়েছে। পরে ইমরানের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে মাদক সেবনের অভিযোগ তোলা হলে হাইকোর্টের নির্দেশে তার ডোপ টেস্ট করা হয়। যশোরের সিভিল সার্জন হাইকোর্টে পেশ করা প্রতিবেদনে ইমরানের শরীরে মাদক গ্রহণের কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করেন বলে জানান ইমরানের বিষয়ে রিট আবেদনকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব। হাইকোর্ট বিষয়টি নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ইমরানের ওপর নির্যাতনের সংবাদে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ১১ জুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়।
রাজধানীর আদাবর থানার মনসুরাবাদ এলাকার মুদি দোকানি মাহবুব আলম দিদার ও তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে গত বছরের ২৮ নভেম্বর। তাঁদের ৩৭০ পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয় বলে মামলায় বলা হয়। ওই দম্পতির অভিযোগ, পুলিশ তাঁদের নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে মাদকের মামলা দিয়েছে। হাইকোর্ট এই দম্পতিকে এরই মধ্যে জামিন দিয়েছেন।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানার ওসিসহ সাত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ‘পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে’ হয়রানির অভিযোগে আদালতে মামলা করেন মেহেরুন্নিসা নামের এক নারী। তাঁর অভিযোগ, ছেলে মেহেদি হাসানকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশ তিন লাখ টাকা দাবি করে। তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করলে ছেলের পকেটে ৪০টি ইয়াবা বড়ি পাওয়ার অভিযোগে মামলা দেয় পুলিশ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেশের বিভিন্ন কারাগার পরিদর্শনে যাওয়া হয়। কারাগারে গিয়ে পরিদর্শন কমিটি সাধারণ বন্দিদের সঙ্গে কথা বলে। এ সময় মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়া অনেক বন্দি অভিযোগ করে, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। তাদের বেশির ভাগেরই অভিযোগ, বাসা থেকে অথবা রাস্তা থেকে প্রথমে পুলিশ ধরে নিয়ে গাড়িতে তোলে। এরপর পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে নাটক সাজিয়ে পরিবার থেকে টাকা আনতে বলে। টাকা দিতে না পারার কারণে তাদের অন্য মামলায় জেলে পাঠিয়েছে পুলিশ।কালের কণ্ঠ
পাঠকের মতামত: