ঢাকা,মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪

‘কী মধু কক্সবাজারে! এই প্রশ্ন যেন আর না ওঠে’

নিউজ ডেস্ক :: সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের দেড় মাস পর কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিদ্যমান কাঠামো পুরোপুরি পাল্টে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত প্রায় ১৪০০ জনকে একযোগে বদলি করা হয়েছে। তাদের পরিবর্তে নতুন ‘সেটআপ’ নিয়ে নতুনভাবে যাত্রা শুরু হচ্ছে কক্সবাজার পুলিশের।

কক্সবাজার জেলা পুলিশে এই গণবদলি নিয়ে শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সঙ্গে কথা বলেছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি জানিয়েছেন, কক্সবাজার পুলিশের মধ্যে পেশাদারিত্ব ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতেই এই বদলি করা হচ্ছে। তার মতে, কী মধু কক্সবাজারে— এই প্রশ্ন যেন আর না ওঠে, সে জন্যই এই বদলি।

সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের পর কক্সবাজারে পুলিশের ইমেজ সংকট দূর করতেই গণবদলি কি না, এ প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘না, না ইমেজ সংকট নেই, ছিলও না। যেটা ছিল সেটা অবশ্যই ভালো ছিল। কিন্তু আমরা চাই, মানুষ চায় যে আরও ভালো হোক, আরও সুন্দর হোক। মানুষের চাওয়ার তো শেষ নেই। সেটাকেই আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। ম্যাসেজটা একবারে ক্লিয়ার— পরিবর্তন করা। যেটা ছিল ভালো ছিল, কিন্তু যেটা আসছে সেটা যদি আরও ভালো হয় তাহলে তো আমাদের কারও অসুবিধা হওয়ার কথা না।’

গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ওই ঘটনায় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস গত ৫ আগস্ট কক্সবাজারের একটি আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছে র‌্যাব। ওই মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর প্রদীপ-লিয়াকতসহ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অভিযুক্ত ১০ পুলিশসহ ১৩ জন এখন কারাগারে আছেন।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় ওঠে। সিনহা হত্যার বিচার দাবির পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য সোচ্চার হন নাগরিকরা। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ।

এ প্রেক্ষাপটে কক্সবাজার জেলা পুলিশকে ঢেলে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে পুলিশ সদর দফতর। শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত বদলির আদেশ এসেছে ১ হাজার ৩৪৭ জনের। এর মধ্যে আছেন পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ আট শীর্ষ কর্মকর্তা, ৫৩ জন পরিদর্শক, ১৩৯ জন উপপরিদর্শক (এসআই), ৯২ জন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), ১ হাজার ৫৫ জন নায়েব ও কনস্টেবল।

ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়েই এই বদলি করা হচ্ছে জানিয়ে ডিআইজি বলেন, ‘একটা কথা তো আপনারাই (সাংবাদিকরা) পত্রপত্রিকায় বারবার লিখতেন যে— কী মজা কক্সবাজারে, কী মধু চকরিয়া থানায়! এ কথাগুলো তো পত্রিকায় এসেছে, আপনারাই তো লিখেছেন। এখন আপনাদের কথা যদি আমরা গুরুত্ব না দিই কিংবা আমলে না নিই, তখন তো আপনারাই আবার লিখবেন— বারবার লিখি, কিন্তু আমলে নেওয়ার কেউ নেই। আপনাদের লেখাকে গুরুত্ব দিয়েই আমরা পুলিশের মধ্যে বারবার কক্সবাজারে আসার সুযোগটা বন্ধ করছি। জনগণ যেটা চায়, যেটা আইনসঙ্গত, মানুষের জন্য কল্যাণকর, সেটাই আমরা করব। কী মজা কক্সবাজারে, কী মধু চকরিয়া থানায়— এই প্রশ্ন যেন আর না ওঠে।’

গণবদলিতে কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা চ্যালেঞ্জ তো অবশ্যই আছে। এই যে পরিবর্তন করা হচ্ছে, এটাও তো একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু চ্যালেঞ্জ তো মোকাবিলা করতে হবে। সাংবাদিক হিসেবে আপনাদেরও সহযোগিতা লাগবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য। অর্থাৎ সবাইকে নিয়েই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চাই। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তো শুধু পুলিশের না। এটা তো সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ সবার দায়িত্ব। সবাইকে নিয়েই আমরা কাজ করতে চাই। একটি ইতিবাচক পরিবর্তন সবাই চায়, আমরাও চাই, এটাই চ্যালেঞ্জ।’

গণবদলির ফলে কক্সবাজারে শূন্য পদ পূরণে চট্টগ্রাম রেঞ্জে পদায়ন করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৫৩ জন পুলিশ পরিদর্শক, ২১৫ জন এসআই-এএসআই এবং ৭৩৪ জন কনস্টেবল। ডিআইজি আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য অনুযায়ী, নতুন সেটআপ দিয়েই কক্সবাজারে পুলিশের নতুন যাত্রা শুরু হবে।

কী বার্তা নিয়ে শুরু হবে নতুন যাত্রা— এমন প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি বলেন, ‘মেসেজটা একদম পরিষ্কার— পুলিশের কাজটা পেশাদারিত্বের সঙ্গে করতে হবে। মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে। সব শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়— এই স্লোগানকে সামনে রেখে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কাজ করে যেতে হবে। অল্প কথায় যদি বলি— আপনি পুলিশ, আপনাকে মানুষকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে হবে। আপনি মানুষকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে কাজ করতে চাইলে, আপনাকে ভাই আমার দরকার নাই।’

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে নবাগত পুলিশ সদস্যদের জন্য বার্তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরবর্তী সব কার্যক্রমই হবে পেশাদারিত্ব নিয়ে। এই একটা বাক্যের মধ্যে অনেক কিছু আছে। পুলিশ কিভাবে কাজ করবে, সেটা তো আইনেই বলা আছে। বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না। মূল কথা একটাই— পেশাদারিত্ব। এটার মধ্যে সব মেসেজ আছে।’

সীমান্তে ইয়াবার চোরাচালান ও বিস্তার রোধে পদক্ষেপের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দিস ইজ অ্যানাদার ইস্যু। সবাই মিলে এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। এটা তো পুলিশ একা চাইলে পারবে না। সীমান্তে সীমান্তরক্ষী বাহিনী আছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর আছে, পুলিশ আছে, সকল শ্রেণিপেশার মানুষ আছে। সবাইকে নিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এটা যদি ছোটখাটো কোনো বিষয় হতো, তাহলে আমাদের পক্ষে একা করা সম্ভব ছিল। যদি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা হতো, তাহলে পুলিশ একা মোকাবিলা করতে পারত।’

কক্সবাজারের মতো চট্টগ্রাম রেঞ্জের অধীন সব জেলায় এই বদলি কার্যক্রম চলবে কি না— জানতে চাইলে ডিআইজি বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে সব জেলায় পরিবর্তন আসবে। তবে কক্সবাজারের মতো হয়তো একেবারে টোটাল চেঞ্জ হবে না। কিন্তু কোথাও যদি প্রয়োজন হয়, জনস্বার্থে, অবশ্যই ব্যক্তিগত স্বার্থে না, পরিবর্তন আনব। আমরা আশা করছি, চট্টগ্রাম রেঞ্জের মধ্যে যে যেখানে আছেন, অবশ্যই সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেউ যদি প্রত্যাশিত আচরণ করতে না পারে, তখন তো পরিবর্তন করা ছাড়া উপায় নেই।’

‘ভালো চালক থাকলেই গাড়ি ভালো চলবে, চালক ভালো না হলে তো গাড়ি ভালোভাবে চলবে না। মাঝপথে গিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং গাড়ি ভালোভাবে চালানোর জন্য তো চালক পরিবর্তন করতে হবে। যার যে দায়িত্ব সেটা সঠিকভাবে পালন করতে হবে। পালন করতে না পারলে চলে যেতে হবে। আমিও যদি আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে না পারি, তাহলে আমিও চলে যাব। কারণ আমি থেকে গেলে তো মানুষের ক্ষতি হবে। সুতরাং যা-ই করা হয়, জনস্বার্থে করা হবে, ব্যক্তিস্বার্থে নয়,’— বলেন ডিআইজি আনোয়ার হোসেন।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের একমাসের মাথায় গত ৩১ আগস্ট পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুককে বদলি করা হয়। গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন তার স্থলাভিষিক্ত হন। সুত্র: সারা বাংলা

পাঠকের মতামত: