নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার থেকে ।।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, হালদা, শঙ্খসহ দেশের নদীসমূহকে দূষণমুক্ত করে পর্যটন বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২৩টি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী জাতীয় নদী সম্মেলনের সমাপনী দিনে এসব প্রস্তাবনা দেয়া হয়। সম্মেলনে নদী বিশেষজ্ঞগণ তাদের উপস্থাপিত প্রবন্ধে দূষণ ও দখলের মধ্য দিয়ে হালদা ও কর্ণফুলী তার নাব্যতা হারাচ্ছে উল্লেখ করে এসব দূষণ ও দখল বন্ধে জাতীয় নদী কমিশনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সম্মেলনের প্রধান অতিথি জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম হালদা ও কর্ণফুলী রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বস্ত করেন।
‘স্বাস্থ্যকর পর্যটন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য টেকসই নদী ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী জাতীয় নদী সম্মেলনের আয়োজন করে ‘বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল’। সম্মেলনে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম। এটিকে কক্সবাজার ঘোষণা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ‘কক্সবাজার ঘোষণা’য় ২৩টি প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে নদী, জলাভূমি বিষয়ক আইন নীতি ও পরিকল্পনা পূন:মূল্যায়ন ও হালনাগাদ করা, দেশের সকল নদ–নদী, খাল–বিল, হাওড়, বাউড়, হৃদ ও মোহনার জলজ সম্পদ এর ইনভেন্টরী করে যথার্থ পরিসংখ্যানসহ প্রকাশ, নদীভিত্তিক পর্যটন ও জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ, নদী পর্যটন বিষয়ে শিক্ষা ও নদী সংরক্ষণ সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, নদী সংরক্ষণ শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন এবং পাঠ্যক্রমে (প্রথম–অষ্টম শ্রেণি) নদী পর্যটন অন্তর্ভুক্ত করা, নদী, জলাভূমি দূষণ ও দখল রোধে সংশ্লিষ্ট আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ, নদী ও তীরবর্তী এলাকায় ব্যবহারবিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, জোনেশন (Zonation) করা, যেমন– শিল্প, আবাসন, বন্দর ও পর্যটন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদী সংশ্লিষ্ট কাজ বাস্তবায়নে যুগোপযোগী করে তোলা, পরিবেশ নীতি, পানি নীতি এবং শিল্প জাতীয় যথাযথ সমন্বয় ও নদী দুষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, নদী পর্যটনকে পরিবেশবান্ধব করার জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড কর্তৃক রিভার ইকো–ট্যুরিজম (River Ecotourism) প্রকল্প গ্রহণ, চট্টগ্রামের শংখ ও হালদা নদীকে জাতীয় নদী হিসেবে ঘোষণা ও সংরক্ষণ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কর্মপরিধি বিস্তৃতকরণ, বহুমাত্রিক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, নদী ও জলজ জীববৈচিত্র সংরক্ষনের জন্য সকল নদীর জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক অভয়াশ্রম তৈরি, নদী সংরক্ষণ, সুষম উন্নয়ন এবং নদীভ্রমণকে বেগবান করার জন্য সরকারি কর্মোদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, নদী পর্যটন কার্যক্রম উন্নয়নে যুবক ও নারীদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান, আন্তর্জাতিক কনভেনশন যেমন– MARPOL, RAMSAR, CBD, UNFCCC ও SDG অনুযায়ী জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি বিষয়ক নদী ও জলজভূমির প্রাকৃতিক গুণাবলি রক্ষা করা এবং নদী পর্যটন উন্নয়ন করা, টেকসই নদী ব্যবস্থাপনায় পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ও সমন্বয়, নদী রক্ষায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামের ভূমিকা কার্যকর করে তোলা, উদ্ধারকৃত নদীগুলো আন্তরিকভাবে সংরক্ষণ করা এবং বেদখলের হাত থেকে রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ, নদী রক্ষার জন্য নদী সংশিহ্মষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মাধ্যমে নদী বাঁচাতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, সরকারের এবং সরকারের আওতাধীন সকল সংস্থার নদী বিষয়ক কাজ কর্ম আরও প্রতিশ্রুতিশীল করা, নদী বিষয়ে কাজ করে এমন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থার সাথে বেসরকারি সংস্থার সমন্বয় নিশ্চিতকরণ, নদীর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নদী কমিশনের মাধ্যমে সকলের নিকট তুলে ধরা এবং ব্যবস্থা গ্রহণ ও নদী রক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য সংস্থা বা ব্যক্তিকে সম্মাননা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
শনিবার কক্সবাজারের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের শেষদিনে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম সভাপতিত্ব করেন। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আখতারুজ্জামান খান কবির, মালয়েশিয়ার টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মোহাম্মদ ওমর ফারুক, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবদুর রহমান, নদী পরিব্রাজক দলের সিনিয়র সহ–সভাপতি সরওয়ার সাঈদ, নদী পরিব্রাজক দল উখিয়া শাখার সভাপতি মো. আলী প্রমুখ।
কী–নোট উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রটেক্টেড এরিয়া পহ্ম্যানার ড. আনিসুজ্জামান খান।
এর আগে গত শুক্রবার বিকালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী সেশনে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম বলেন, ‘পৃথিবীর সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে নদী। জীবন ছবির প্রাণকেন্দ্র এই নদী। কিন্তু আমরা আমাদের অস্থিত্বকে ভুলে গেছি, সভ্যতাকে ভুলে গেছি। তাই তো আমরা নদীকে বাঁচতে দিচ্ছি না। আমাদের অজ্ঞতা, আমাদের লোভ নদীকে বাঁচতে দিচ্ছে না। নদীকে বাঁচাতে পারলে ট্যুরিজম এমনিতেই এগিয়ে যাবে। তাই আমরা নদীকে ফিরিয়ে দিতে চাই তার জীবন।’
তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে দেশের সকল নদ–নদী ও জলাশয়ের সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ করে নদ–নদী রক্ষায় সকলকে সম্পৃক্ত করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে টেকসই ব্যবস্থাপনায় নদীর সুপরিবেশ সৃষ্টি করে প্রকৃতিবান্ধব পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরি করে নদী রক্ষা কার্যক্রম বেগবান করা হবে।’
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ড. অপরূপ চৌধুরী বলেন, ‘শুধু পানি নয়, নদী আমাদের পুষ্টির আধার। বাংলাদেশের নদী জীববৈচিত্রে ভরপুর। নদীর প্রবাহ হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীতে তৃতীয় স্থানে আছে বলা যায়। আমাজন নদী এক নাম্বার ও কঙ্গো নদী দুই নাম্বারে রয়েছে। তবে প্রতিটি পর্যটনই দূষণ তৈরি করে। সেই তুলনায় নৌ পর্যটন কম দূষণের। এছাড়াও একজন নৌ পর্যটকের কারণে অন্তত ৭ জন মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রটেকটেড এরিয়া পহ্ম্যানার ড. আনিসুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের সভাপতি মো. মনির হোসেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ড. অপরূপ চৌধুরী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. আলাউদ্দিন বক্তব্য রাখেন।
উদ্বোধনী সেশনে মালয়েশিয়া সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন গাই ওয়েংয়ের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মালয়েশিয়া টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মো. ওমর ফারুক। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া চট্টগ্রামের হালদা নদী নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। উদ্বোধনী সেশনের আগে বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের সাংগঠনিক সেশনে পরিবেশবাদী এই সংগঠনটির ৫১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত হয়।
দুইদিনের এই সম্মেলনে দেশের শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা ও গবেষকগণ তাদের গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। কনফারেন্সে দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ করা ১২০ জন নদীপ্রেমী অংশ নিয়েছেন।
পাঠকের মতামত: