ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

কক্সবাজার সৈকতজুড়ে বিষাক্ত ‘লাল জোয়ার’

আহমদ গিয়াস :: কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় ১শ কিলোমিটার ব্যাপী সমুদ্র সৈকতজুড়ে আচঁড়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরের বিষাক্ত ‘লাল জোয়ার’! গত ফেব্রুয়ারি শেষদিক থেকে সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বিষয়টি লক্ষ্য করলেও সম্প্রতি বিষয়টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে করছেন তারা। এ ‘লাল জোয়ার’ই সাম্প্রতিক বঙ্গোপসাগরে তিমি মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলেও ধারণা বিজ্ঞানীদের। এছাড়া গত মাসের শেষদিকে কক্সবাজারের চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলোর প্রায় দেড়শত কোটি পোনা মারা যাওয়ার ঘটনায় সাগরের এ ‘বিষাক্ত’ পানিকেই দূষছেন হ্যাচারি মালিকরা।

তবে আবহাওয়াগত কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাগরগুলোতে মাঝেমধ্যেই এমন ’লাল জোয়ার’ এর ঘটনা ঘটে বলে জানান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ড. শফিকুর রহমান।

তিনি বলেন, ক্রমাগত তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে এবং দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হলে ক‚লবর্তী সাগর ও নদীতে এক ধরনের ক্ষতিকর ফাইটো প্লান্কটন (উদ্ভিজ্জ অনুজীব) বিস্তার করে। এই প্লা্কংটনগুলো পানির কলামে মিশে থাকা অক্সিজেন উপর দিকে তুলে আনে। যার কারণে পানির নীচের দিকে অক্সিজেন শূণ্যতার তৈরি হয় এবং পানিতে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি জলজ প্রাণীর জন্য হয় মারাত্মক।
বৃষ্টিপাত হলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, গত ফেব্রæয়ারির শেষদিক থেকেই আমরা এই ‘লাল জোয়ার’ এর বিষয়টি লক্ষ্য করছি। তবে সম্প্রতি বিষয়টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে। এ ‘লাল জোয়ার’ই সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে তিমি মৃত্যুর অন্যতম কারণ হতে পারে।

তিনি বলেন, এক ধরনের ক্ষতিকর ফাইটো প্লান্কটনের (উদ্ভিজ্জ অনুজীব) কারণে সাগরের পানির রঙ হলুদ বা বাদামীতে রূপান্তরিত হয়। হার্মফুল এলগার্ল ব্লোম বা এইচএবি (HAB) নামে পরিচিত সেই বাদামী বা হলুদ পানির জোয়ারই বিশ^ব্যাপী ‘লাল জোয়ার’ নামে পরিচিত। একারণে সাগরের মাছসহ অন্যান্য প্রাণীর জীবন হুমকীর মুখে পড়ে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের ভূ-তাত্ত্বিক ওশানোগ্রাফি বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বলেন, নদী মোহনা ও সমুদ্র উপকুলে হলুদ বা বাদামী রঙের হার্মফুল এলগার্ল ব্লোম বা এইচএবি (HAB) অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে পৌঁছালেই এই লাল জোয়ারের সৃষ্টি হয়। নদীর স্বাদু পানি যখন সমুদ্রের লবণাক্ত ভারী পানির সাথে মিশে, তখন সেটি সমুদ্রের পানির কলামে হরাইজন্টালি বা আনুভ‚মিকভাবে স্তর পূন:বিন্যাস (স্ট্রেটিফিকেশন) না করে ভার্টিক্যালি বা উল্লম্বভাবে বিন্যস্ত হলেই সাগরের পানিতে অক্সিজেন শূণ্যতা তৈরি হয়। যেটি লাল জোয়ার নামে পরিচিত।

তবে কক্সবাজারে গত তিন দশকে এমন ঘটনা নজিরবিহীন বলে জানান সমুদ্রপাড়ের জেলেপল্লীর বাসিন্দারা। কক্সবাজার শহরের দরিয়ানগর ঘাটের বোট মালিক নজির আলম বলেন, সাগর থেকে মাঝেমধ্যেই এমন দূর্গন্ধযুক্ত গেজাইন্যা (ময়লাযুক্ত পানি ও আবর্জনা) ভেসে আসে। কিন্তু গত প্রায় এক মাস ধরে যে ঘটনা দেখা যাচ্ছে, তা আগে কখনও দেখা যায়নি।
কলাতলীর জেলে আবদুল গফুর বলেন, গত প্রায় ২/৩ মাস ধরেই সাগরের পানি বর্তমানে ঘোলাটে রয়েছে। যে কারণে মাছও ধরা পড়ছে খুব কম।

এছাড়া গত মাসের শেষদিকে কক্সবাজারের চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলোর প্রায় দেড়শত কোটি পোনা মারা যাওয়ার ঘটনায় সাগরের এ ‘বিষাক্ত’ পানিকেই দূষছেন হ্যাচারি মালিকরা।

কক্সবাজারের চিংড়ি পোনা হ্যাচারীগুলোর সংগঠন শ্রীম্প হ্যাচারী এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (শ্যাব) মহাসচিব নজিবুল ইসলাম চকরিয়া নিউজকে বলেন, কক্সবাজারের ৩০টি হ্যাচারি গত ফেব্রæয়ারি মাস থেকে পোনা উৎপাদন করছে। কিন্তু এপ্রিলের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে হঠাৎ কক্সবাজারের হ্যাচারীগুলোর পোনা মরে যেতে শুরু করে। ইতোমধ্যে প্রায় দেড়শ কোটি পোনা মরে যাওয়ায় অধিকাংশ হ্যাচারীর উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।

তিনি জানান, কক্সবাজারের হ্যাচারীগুলোতে সাগর থেকে সংগৃহীত লবণাক্ত পানিতে কৃত্রিম উপায়ে মা মাছ থেকে পোনা ফোটানো হয়। কিন্তু সাগরের পানি ‘বিষাক্ত’ হয়ে পড়লে পোনা মারা যায়।
তবে পোনা মারা যাওয়ার আরো অনেক কারণ থাকতে বলে মনে করেন সমুদ্রবিজ্ঞানীরা।

কক্সবাজারের আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, গত ৬ মাসে কক্সবাজারে কেবল একবারই সামান্য বৃষ্টিপাত হয়েছে। যে কারণে গত মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রীর উপরে ওঠানামা করছে।

পাঠকের মতামত: