আন্তর্জাতিক ডেস্ক ::
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে প্রাণহানির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চীনে। ২০০৩ সালের সার্স মহামারির চেয়ে করোনাভাইরাস গুরুতর আকার ধারণ করায় পরিস্থিতি সামলাতে দেশটির সরকার জরুরিভিত্তিতে মেডিকেল সরঞ্জাম এবং সার্জিক্যাল মাস্ক প্রয়োজন বলে জানিয়েছে।
গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তের পর এই ভাইরাসে দেশটিতে এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে অন্তত ৩৬২ জনের। সোমবার পর্যন্ত নতুন এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ২০৫ জনে।
ডিসেম্বরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর গতকাল রোববার একদিনে সর্বোচ্চসংখ্যক ৫৭ জন নিহত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহানে একটি সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকে প্রাণীর দেহ থেকে মানুষের মাঝে সংক্রমণ ঘটিয়েছে নতুন এ ভাইরাস।
তখন থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের অন্তত ২৪টি দেশে ছড়িয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকটে জরুরি অবস্থা জারির পর বিশ্বের অনেক দেশ চীন থেকে আসা মানুষদের প্রবেশে নজিরবিহীন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। চীনের বাইরে রোববার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজনের প্রাণহানি ঘটেছে ফিলিপাইনে।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং বলেছেন, এই মুহূর্তে চীনের জন্য জরুরিভিত্তিতে মেডিকেল মাস্ক, সুরক্ষা স্যুটস এবং চিকিৎসকদের নিরাপত্তা চশমা দরকার।
গুয়াংডং-সহ দেশটির যেসব প্রদেশের বাসিন্দা ৩০ কোটির বেশি সেসব শহরে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর প্রত্যেকের জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু দেশটির কারখানাগুলোর দিনে মাত্র ২ কোটি মাস্ক তৈরির সক্ষমতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন চীনের শিল্প-প্রতিষ্ঠানবিষয়ক বিভাগের মুখপাত্র তিয়ান ইউলং।
তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ ইউরোপ, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাস্ক আনার পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, কাজাখস্তান, হাঙ্গেরি-সহ বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি দেশ মেডিকেল সহায়তায় হাত বাড়িয়েছে।
উহানের নতুন এই ভাইরাস দেশটির অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান ভারি প্রভাব ফেলছে। পুরো চীনজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় থমকে গেছে। বিশ্বের প্রভাবশালী বেশ কিছু কোম্পানি চীনে তাদের কল-কারখানার উৎপাদন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশ চীন ভ্রমণে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকার পর সোমবার সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ (এসএসই) খোলা হয়। দিনের শুরুতেই সূচক পড়ে গেছে প্রায় আট শতাংশ; যা গত এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। উদীয়মান শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত চীনের উহান শহর এখন ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণের তীব্র আতঙ্ক শহরটিতে কার্যত অবরুদ্ধ অবস্থায় বসবাস করছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
শহরটির চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা রোগীদের সেবা দিতে হাঁপিয়ে উঠছেন। সোমবার দেশটির সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া বলছে, ৮ হাজার ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত ৬৮টি মেডিকেল টিমকে উহান থেকে হুবেইয়ে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানে নতুন করে চিকিৎসা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তীব্র চাপের মুখে চীন সরকার উহানে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় নতুন দুটি হাসপাতাল নির্মাণ করছে। মাত্র ১০ দিনে নির্মিত এক হাজার শয্যার একটি হাসপাতালে সোমবার থেকে করোনার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এই হাসপাতালে দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রায় ১ হাজার ৪০০ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
চীনে এমন এক সময় এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটে; যখন লাখ লাখ চীনা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশে পাড়ি জমান নতুন চন্দ্রবর্ষ উদযাপনের জন্য। সপ্তাহব্যাপী নতুন চন্দ্রবর্ষ উদযাপন আনুষ্ঠানিকভাবে গত শুক্রবার শেষ হয়েছে। সংকট মোকাবিলায় দেশটির সরকার এক সপ্তাহের ছুটি বাড়িয়ে ১০ দিন করে।
এই ছুটি শেষ হয়ে গেলেও সাংহাই-সহ দেশটির প্রধান প্রধান কিছু শহর তা বৃদ্ধি করেছে। দেশটির অনেক স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। সোমবার চীনের পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, ছুটি শেষে কোটি কোটি মানুষ কর্মক্ষেত্রে ফেরার কথা থাকলেও রোববার রাস্তাঘাট ছিল জনমানব শূন্য। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়নি।
সিনহুয়া বলছে, ট্রেনে এবং বিমানে ভ্রমণ কমে গেছে যথাক্রমে ৭৪ শতাংশ এবং এক পঞ্চমাংশ। ভ্রমণ এড়াতে অনেক কোম্পানি বাসায় থেকে কর্মীদের কাজের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে অনেক কোম্পানি এখনও বন্ধই রয়েছে।
বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংস্থা গ্রুপ অব সেভেন (জি-৭) ভুক্ত কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী মিলেছে। বিদেশিদের মধ্যে যারা সম্প্রতি চীন ভ্রমণ করেছেন; তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ইসরায়েল। এমনকি নিজ দেশের নাগরিকদের ভ্রমণেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
এছাড়া ইতোমধ্যে বিশ্বের বেশ কয়েকটি চীন থেকে নিজ দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। চীন থেকে ফেরত আনার পর বেশ কয়েকটি দেশ নাগরিকদের কোয়ারান্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক করেছে। চীনে বিমান চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বেশ কিছু দেশের বিমান পরিবহন সংস্থা।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যথাযথ সহায়তা না করে সতর্কতা জারি করে নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বলে সোমবার অভিযোগ করেছেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। হুয়া চুনিং বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের কর্মকাণ্ড আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া এবং নেপাল ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। আধা-স্বায়ত্তশাসিত হংকং দুটি ছাড়া চীনের সঙ্গে সব স্থল সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে।
পাঠকের মতামত: