নিউজ ডেস্ক :: ফাইল ছবি
আত্মসমর্পণের জন্য ৬৬ মাদক ব্যবসায়ী পুলিশি হেফাজতে ফেব্রুয়ারিতে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা হতে পারে প্রথম দফায় ৮০ মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করতে পারেন মাদক ব্যবসায়ীদের হেফাজতে রাখার কথা অস্বীকার পুলিশের মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান অব্যাহত আছে বলছে পুলিশ
আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশি হেফাজতে থাকা মাদক ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ২৫২ জন ইয়াবা কারবারির তালিকা চূড়ান্ত করেছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। তাঁদের ধরার লক্ষ্য নিয়েই অভিযান হচ্ছে। এর মধ্যে ৫০ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা কোটি কোটি টাকার ইয়াবার চালান আনলেও পুলিশ তার কিছুই টের পায়নি। তাঁদের সঙ্গে ১৫ জন হুন্ডি ব্যবসায়ীও আছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় তাঁদের কারও নাম নেই। অনেকের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই।
কক্সবাজার জেলা ও টেকনাফ থানার পুলিশের একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে এ তথ্য দিয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের নিজেদের হেফাজতে রাখার কথা গতকাল শনিবারও স্বীকার করেননি কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন। তিনি শুধু বলেছেন, মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান অব্যাহত আছে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের নিয়মিত অভিযান ও তদন্তে বেশ কিছু বড় কারবারির নাম পাওয়া গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে।
বড় কারবারি বলতে পুলিশ কাদের বুঝিয়ে থাকে—এমন প্রশ্নের জবাবে টেকনাফ থানার ওসি বলেন, একেকটি চালানে যাঁরা কমপক্ষে ২০-৩০ লাখ পর্যন্ত ইয়াবা আনেন, তাঁদেরই বড় কারবারি হিসেবে ধরা হয়। পুলিশ নতুন করে যেসব বড় ইয়াবা কারবারির তালিকা করেছে, তাঁদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি আছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। কেউ কেউ ইয়াবার পাশাপাশি মানব পাচার করে থাকেন, কারও কারও বিরুদ্ধে হত্যা মামলা আছে বলে জানা গেছে।
আত্মসমর্পণের জন্য ৬৬ জন মাদক ব্যবসায়ী এখন কক্সবাজার জেলা পুলিশের হেফাজতে আছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা হতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তারা আশা করছেন, প্রথম দফায় ৮০ জন মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করতে পারেন।
জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযানের জন্য তাঁরা ২৫২ জনের যে তালিকা করেছেন, তাঁদের ৫০ জনকে ‘গডফাদার’ হিসেবে মনে করছেন। এত দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ৭৩ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা ধরে অভিযান চলছিল। পুলিশের আশঙ্কা, তালিকায় না থাকায় এই ৫০ জন এত দিন নিরুপদ্রবেই তাঁদের কাজ চালিয়ে গেছেন। ২৫২ জনের মধ্যে সাবরাংয়ের ৫৩ জন, টেকনাফ পৌরসভার ২১, শাহপরীর দ্বীপের ৭, হ্নীলার ৭৪, সদর ইউপির ৭০ ও অন্যান্য স্থানের আছেন ২৭ জন।
সূত্রগুলো বলছে, গুরুত্বপূর্ণ কারবারিদের মধ্যে আছেন সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শামসুল আলম ও তাঁর ভাই আলমগীর, কাটাবনিয়ার শওকত আলম, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুরবিল এলাকার মো. তৈয়ব ওরফে মধু তৈয়ব, আলুরডেইলের জাফর। সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রেজাউল করিমও বড় কারবারি; তবে সম্প্রতি তিনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, কক্সবাজার থেকে ইয়াবা চোরাচালানে হুন্ডির যত টাকা লেনদেন হয়, তার ৪০ শতাংশই টি টি জাফর নামে এক ব্যক্তি করে থাকেন। জাফর বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি করতেন মিয়ানমারে আর মিয়ানমার থেকে গবাদিপশু নিয়ে আসতেন। তিনি সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, মিয়ানমারকেন্দ্রিক হুন্ডি ব্যবসায়ীদের একটি চক্রের সদস্য।
আট পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা
উপর্যুপরি অভিযানে টেকনাফে ইয়াবার প্রবেশ আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছে মাঠে থাকা সব কটি সংস্থা ও স্থানীয় লোকজন। তবে ইয়াবার প্রবেশ বন্ধ হয়নি। গতকাল শনিবার র্যাব-৭-এর একটি দল ৪ হাজার ৭০০ ইয়াবসহ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার বিজিবি উদ্ধার করেছে দেড় লাখ ইয়ারা। টেকনাফ-২ বিজিবির ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক শরীফুল ইসলাম জোমাদ্দার জানান, শুক্রবার উত্তর জালিয়াপাড়ায় একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে প্লাস্টিকের জারিকেনের ভেতর ১ লাখ ৩০ হাজার ইয়াবা এবং বৃহস্পতিবার সাবরাংয়ের ১ নম্বর স্লুইস গেট থেকে আরও ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার হয়। তবে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস বলেন, এখন যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো আগেই ঢুকেছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর আগে ২৪টি পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা ঢুকলেও এখন সক্রিয় আছে আটটি পয়েন্ট। এই আটটি পয়েন্টে চলতি মাসে ১৩ জন পাচারকারী নিহত হয়েছেন। উদ্ধার হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৪০০ ইয়াবা ও ১০টি অস্ত্র।
কীভাবে ইয়াবা ব্যবসা চলছে—জানতে চাইলে মুন্ডারডেইলের নৌযানশ্রমিক আবুল হোসেন বলেন, অনেকে মাছ ধরার ভান করে নৌকা ভাসায়। তারপর সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে মিয়ানমারের জলসীমার কাছে গিয়ে ওদের দেশের নৌযান থেকে ইয়াবা তুলছে। এ ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে ছেঁড়াদিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব দিক, মৌলভি শিল, নাইক্ষ্যংডিয়ায়। এ রকম ১৭টি নৌকা কে বা কারা পুড়িয়ে দিয়েছে। নৌকাগুলোর ১০ জন মালিকের একজন শাকের আহম্মদ আত্মসমর্পণ করতে কক্সবাজার গেছেন। বাকিরা পলাতক। এমন কাজে যুক্ত থাকা নৌযানমালিকের সংখ্যা দেড় শতাধিক বলে তাঁরা জানান।
শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন ইয়াবা কারবারির বাড়ি সাবরাংয়ে। তাঁদের একজন আখতার কামাল বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তাঁর ছোট ভাই শাহেদ কামাল ও আবদুর রহমান বদির ভাগনে শাহেদুর রহমান নিপুর বাড়িও এই এলাকায়। তাঁরা দুজন এখন আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশ লাইনসে আছেন। তবে বাহারছড়া ও মুন্ডারডেল এলাকার একজন নৌযানমালিক নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বড় কারবারিরা গা ঢাকা দিলেও সেই জায়গাটা কত দিন ফাঁকা থাকবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। নজরদারি না থাকলে যারা চুনোপুঁটি ছিল, তাদের রাঘববোয়াল হয়ে উঠতে সময় লাগবে না।
পাঠকের মতামত: