এইচএম এরশাদ ॥ বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে সমঝোতা স্মারক হয়েছে। সে অনুযায়ী আগামী ২২ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এ প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার সরকার আদৌ ইচ্ছুক বা আন্তরিক কিনা সে প্রশ্ন এখনও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যসহ আগ্রহী সকল মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেননা, এখন প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ফাঁকা গুলিবর্ষণের আওয়াজে রাখাইন রাজ্য প্রকম্পিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে ওপারের সূত্রগুলো রাখাইন রাজ্যের সরকারী সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ফাঁকা গুলিবর্ষণের এ ঘটনা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সদস্যদের। পক্ষান্তরে, রোহিঙ্গা সূত্রগুলো বলেছে মূলত রাখাইনে সেনাঘাঁটিতে অবস্থানরত সদস্যরা প্রতিরাতে পরিকল্পিতভাবে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করছে। যাতে রোহিঙ্গাদের ইচ্ছা থাকলেও ভীতিকর পরিবেশ নিয়ে সেখানে ফিরে না যায়। আর যারা রাখাইন রাজ্যে অবস্থান করছে সেসব রোহিঙ্গারাও যেন প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে চলে আসে। মঙ্গলবার ভোরে তিনটি ইঞ্জিনবোটযোগে আরও ১০৯ রোহিঙ্গা টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে কচুবুনিয়া পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এসব রোহিঙ্গারা এসেছে বুচিদং এর সিন্দিপাড়া থেকে। তারা দাবি করেছে, রাখাইনে সেনাবাহিনীর অত্যাচার নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার ইতোপূর্বে সেনা অভিযান বন্ধ রাখার যে ঘোষণা দিয়েছে তা পুরোপুরি সত্য নয়। গণহত্যা এখন নেই, কিন্তু নানামুখী অত্যাচার নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে অত্যাচারের অগ্রভাগে রয়েছে উগ্র মগ সন্ত্রাসীরা।
যেসব নতুন নতুন রোহিঙ্গা প্রতিদিন পালিয়ে আসছে তাদের পক্ষে সেখানকার যে তথ্য এদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে তা ইতিবাচক নয়। উল্টো চরম ভীতিকর। যারা আগেভাগে চলে এসেছে এবং আশার পর দেশী বিদেশী গণমাধ্যম ও প্রতিনিধি দলের কাছে রাখাইন রাজ্যে ঘটে যাওয়া গণহত্যা, নারী ধর্ষণসহ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার তথ্য প্রকাশ করেছে তারা ফিরে গেলে নিশ্চিতভাবে তাদের জন্য বড় ধরনের বিপদ নেমে আসবে। কেননা, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বক্তব্যের সূত্র ধরেই আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমার বড় ধরনের বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বরতা চলেছে তা সচিত্র প্রতিবেদন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ধারণ করে তা বিশ্বজুড়ে প্রকাশ হয়েছে। যেখানে দেখা গেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ, উগ্র মগ সন্ত্রাসীরা কিভাবে বর্বরতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এসব ঘটনা দিবালোকের মতো সত্য হলেও মিয়ানমার সরকার বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে। উল্টো বলেছে, এসব ঘটনা রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যেই সৃষ্ট। এছাড়া মিয়ানমার আরও দাবি করে আসছে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়। তারা বাংলাদেশ থেকে সে দেশে অনুপ্রবেশ করে অবৈধভাবে বসবাস করছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গারা সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি রয়েছে মিয়ানমারের।
গত ২৫ আগস্ট রাতের পর সেনা অভিযান শুরু হলে রোহিঙ্গাদের গণহারে হত্যা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া এবং কোন কোন ক্ষেত্রে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটতে থাকে। ফলশ্রুতিতে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সীমান্ত অভিমুখী হয়। দুদিনের মাথায় বাংলাদেশ অঘোষিতভাবে মানবিক কারণে তাদের প্রবেশের অধিকার দেয়। ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। প্রথমে হাজার হাজার, পরবর্তীতে শয়ে শয়ে রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুর অনুপ্রবেশে সয়লাব হয়ে আছে টেকনাফ থেকে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশী এলাকা। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা এলাকা আধিক্য হচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফ। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশকালে প্রথমদিকে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমানা অতিক্রম করে, ড্রোনও দেখা যায়। এর পাশাপাশি পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যাতে পুনরায় ফিরে যেতে না পারে সেজন্য পুরো সীমান্ত এলাকায় বিপুলসংখ্যক মাইন স্থাপন করে মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন ও রীতিনীতির লঙ্ঘন ঘটায়, যা বিশ্ব নজরে আসার পর এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার তীব্র সমালোচনার পর কখনও পিছ পা হয়নি। আরও পরবর্তীতে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বক্তব্য বিবৃতির পরও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের দমন নিপীড়ন থেকে নিবৃত থাকেনি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো দালিলিক প্রমাণসহ বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও বিতাড়নের চিত্র।
এ অবস্থায় জাতিসংঘের পক্ষ থেকে দফায় দফায় এবং সর্বশেষ ওআইসির একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে জাতিসংঘে পাস হয়েছে। এর আগে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দুপক্ষের একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়েছে। রূপরেখা অনুযায়ী আগামী ২২ জানুয়ারির মধ্যে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ধাপে ধাপে প্রত্যাবাসনের কথা রয়েছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে প্রশ্ন উঠেছে, মিয়ানমার আদৌ এদের ফিরিয়ে নেবে কিনা। নাকি আগেকার মতো লোক দেখানো কিছু রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিয়ে সে দেশের আশ্রয় ক্যাম্পে রেখে বিশ্বকে লোভ দেখানো নাটকের অবতারণা করবে। এমনিতর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে বড় ধরনের ভীতি জন্মেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতারা ক্ষেত্রবিশেষে ভীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে প্রতিরাতে যে গুলিবর্ষণের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে তা মূলত সে দেশের সেনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। যদিও মিয়ানমার থেকে বলা হচ্ছে এ ঘটনা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের। এ বিষয়ে টেকনাফে বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, রাখাইনে গুলি বর্ষণের ঘটনা নিয়ে আমাদের বলার কিছুই নেই। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটলে এ নিয়ে অবশ্যই প্রতিবাদ জানানো হবে। প্রয়োজনে পতাকা বৈঠকের আয়োজন করা হবে।
এদিকে, এ পর্যন্ত ৯ লাখ ৫ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। আরও তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এখনও নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এছাড়া মংডু শহরের অদূরে মোস্তাফিজপাড়া ছামিলাপাড়া, কুয়াইনচিবং গ্রামের ১০ হাজারেরও অধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টের দমখালিতে অবস্থান করছে। এসব রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশমুখী হয়ে আছে। সেখান থেকে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। এদেরই ১০৯ জনের একটি দল মঙ্গলবার সকালে শাহপরীরদ্বীপে কচুবুনিয়া পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত বর্বর ঘটনায় ৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে। ৫০ হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ২ লাখের সামান্য বেশি রোহিঙ্গা গোটা রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে। এদের কিছু মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনী ও পুলিশের অনুগত হয়ে বসবাস করছে। বড় একটি অংশকে রেখেছে কড়া নজরদারিতে। যারা একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে পারে না। আরেকটি অংশকে রাখা হয়েছে ক্যাম্পে। বহু আগে থেকেই এরা ক্যাম্পবাসী হয়ে আছে। প্রত্যাবাসন শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর সেখানকার তংপিউ লেট গ্রামে যে দুটি ব্যারাক নির্মিত হচ্ছে সেখানে ফিরিয়ে নেয়া রোহিঙ্গাদের রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিয়ানমার। এ দুটি ব্যারাকে কত রোহিঙ্গার স্থান হবে, যেখানে নতুন পুরনো মিলিয়ে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে, সেখানে সে দেশের সরকারী কার্যক্রমে পরিলক্ষিত হচ্ছে না সব রোহিঙ্গাদের যে ফিরিয়ে নেয়া হবে।
বিষয়টি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝেও আস্থা অর্জন করতে পারছে না। এছাড়া সেখানে গিয়ে পুনরায় তাদের দিনের পর দিন শঙ্কায় যে থাকতে হবে তা নিয়েও তারা নিশ্চিত। গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযানের মাধ্যমে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে সাড়ে ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। কিন্তু বেসরকারী পরিসংখ্যানে তা আরও অনেক বেশি। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের যেমন কিছু শর্ত রয়েছে তেমনি ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদেরও অনুরূপ কিছু শর্ত রয়েছে। দু’পক্ষের শর্ত সহজে পূরণ হবার নয়। কেননা, অন্যতম শর্ত হচ্ছে নাগরিকত্ব। মিয়ানমার সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়, যা ৯২ সালে কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর রোহিঙ্গারা বলছে, নাগরিকত্ব ছাড়া পুনরায় রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাবার প্রশ্নই উঠে না। এ নিয়ে আশ্রিত ক্যাম্পগুলোতে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর নেতাকর্মীরা। সঙ্গত কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি আদৌ কার্যকর হবে কিনা, হলেও তা কতটুকু সফলতা আসবে তা নিয়ে সকল মহলে বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি নির্ভর করছে মিয়ানমার সরকারের ওপর। বর্তমান এনএলডি সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে যদি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চায় তাতেই নির্ভর করছে সামগ্রিক সফলতা। এ অভিমত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কর্মরত দেশী বিদেশী সংস্থা, সাহায্য সংস্থা ও কক্সবাজার অঞ্চলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিটি নেতৃবৃন্দের।
পাঠকের মতামত: