চকরিয়া নিউজ ডেস্ক::
যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের অন্যতম শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মং মং সোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, মেজর জেনারেল মং মং সোর নেতৃত্বেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
তিনি যে হত্যাযজ্ঞ, যৌন সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আছে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ও এখতিয়ারভুক্ত অঞ্চলে মেজর জেনারেল মং মং সোর সব সম্পদ (যদি থাকে) বাজেয়াপ্ত করা হবে। সেগুলো অন্যত্র স্থানান্তরও করা যাবে না। মেজর জেনারেল মং মং সোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কেউ কোনো আর্থিক লেনদেন করতে পারবে না। মং মং সো যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘বার্মিজ (মিয়ানমারের) সেনাবাহিনী পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় মং মং সো রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান তদারকি করেন। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির হামলার প্রতিক্রিয়ায় ওই সামরিক অভিযানে বেসামরিক রোহিঙ্গাদের ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। ’
অর্থ মন্ত্রণালয় আরো বলেছে, “যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন গত ২২ নভেম্বর মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যা, যৌন সহিংসতা ও কারণ ছাড়াই গ্রেপ্তারের পাশাপাশি ব্যাপক হারে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়াসহ মং মং সোর কর্মকাণ্ড বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, মিয়ানমার বাহিনীর নিরাপত্তা অভিযানের কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মং মং সোর নেতৃত্বেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী পুলিশ গত আগস্ট মাসে উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও গ্রামে আগুন দিয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে। ওই মাসেই মং মং সোর অধীন সেনারা রোহিঙ্গাদের একটি গ্রামে ঢোকে এবং নারীদের পুরুষদের থেকে আলাদা করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যানুযায়ী, মং মং সোর অধীন সেনারা পুরুষদের ওপর গুলি চালায় এবং নারীদের ধর্ষণ করে। নারী ও শিশুদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে জানা যায়। অন্য প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে, সেনারা গ্রামবাসীদের ঘরের ভেতর আটকে রেখে আগুন দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন গত মাসে নেপিডো সফরের প্রাক্কালে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মেজর জেনারেল মং মং সোকে দেশটির সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের নেতৃত্ব থেকে প্রত্যাহার করে। টিলারসনের সফরের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির খোঁজ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান চালিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
গত সপ্তাহের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের এক হোতাকে যুক্তরাষ্ট্র চিহ্নিত করতে পেরেছে। অন্য হোতাদেরও চিহ্নিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন ওঠে, মেজর জেনারেল মং মং সোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমার সরকারের বেসামরিক অংশের সঙ্গে কী ধরনের আলোচনা করেছে? আরো নিষেধাজ্ঞা আসছে কি? জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন মিয়ানমারের বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রকাশ্যে ও আড়ালে—উভয়ভাবেই স্পষ্ট করেছেন, আমরা রাখাইন রাজ্যে নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চাই। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে ও আড়ালে যা বলেছেন তার সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত (নিষিদ্ধ তালিকায় অন্তর্ভুক্তি) প্রাসঙ্গিক। ’
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে আরো তদন্ত ও ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তাঁরা আগাম কিছু বলেন না। প্রয়োজনে মিয়ানমারের কর্মকর্তারাসহ যে কেউ ওই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারেন।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বৃহস্পতিবার রাতে ‘গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাক্টের’ আওতায় ৫২ জন বিদেশির ওপর নিষেধাজ্ঞার নির্বাহী আদেশে সই করেন। মিয়ানমারের মেজর জেনারেল মং মং সো তাদেরই একজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ‘শাস্তি’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ওই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, হয়তো মেজর জেনারেল মং মং সোর যুক্তরাষ্ট্রে বাজেয়াপ্ত হওয়ার মতো কোনো সম্পদ নেই বা তিনি হয়তো এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে যেতেও আগ্রহী হবেন না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ মিয়ানমারের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর যে নিষোধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করেছে তা গুরুত্ববহ। এতে মিয়ানমারের, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ বাড়বে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্ট নতুন করে শুরু হওয়া নিধনযজ্ঞে কতজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার যায়ীদ রা’দ আল হুসেইন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গণহত্যার জোরালো আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মিয়ানমার বিদেশিদের রাখাইন রাজ্যে যেতে দিচ্ছে না, এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূতের সফরও আটকে দিয়েছে।
সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল (এমএসএফ) বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, গত ২৫ আগস্ট থেকে কথিত বিদ্রোহীদের ধরপাকড়ের নামে সামরিক বাহিনীর অভিযানের প্রথম মাসেই অন্তত ছয় হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। গত সপ্তাহেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বসতি ছিল এমন একটি স্থাসে গণকবরের সন্ধান মিলেছে। যে মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ সেই বাহিনী নিজেই এর তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপের তথ্যানুযায়ী, ২৫ আগস্টের পর থেকে ছয় লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে দুই দেশ আলোচনা চালালেও মিয়ানমারের আন্তরিকতার ঘাটতি আছে। সুত্র: কালেরকন্ঠ
পাঠকের মতামত: