ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

রাশেদাই যত গণ্ডগোলের মূল, চট্টগ্রামে বাপ্পী হত্যায় কথিত স্ত্রীসহ আটক ৬

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি ::

হয় সামাজিক স্বীকৃতি, নয়তো কাবিনের টাকা বাড়িয়ে দেওয়া এ দুটোর যেকোন একটি মানতে আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীর উপর উপর্যপুরি চাপ সৃষ্টি করছিল তার স্ত্রী রাশেদা। কিন্তু কোনভাবেই বাপ্পীকে কাবু করতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত চেয়েছিল তাকে ভয় দেখিয়ে কাবিনের টাকা বাড়াতে। পেশাদার খুনি না হওয়ায় কাজে গড়বড় করে ফেলে রাশেদা ও তার পাঁচ সহযোগী। চ্যাঁচামেচি বন্ধ করতে স্কচটেপ দিয়ে মুখ বন্ধ করছিল তারা। সেই সময়ই শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায় বাপ্পী। ঘটনার পর পরই বের হয়ে যায় রাশেদা ও তার ‘নতুন’ বন্ধু হুমায়ূন। বাকি চার জনের বোধোদয় হয়, যে কাজ করেছে, আজ হোক কাল হোক ধরা পড়বেই। এ চারজন রাশেদার ঘাড়ে পুরো দোষ চাপিয়ে দিতে বাপ্পীর পুরুষাঙ্গ কেটে নেয়, যেন সকলে ভাবে রাশেদা–ই প্রতিশোধ নিতে পুরো ঘটনাটি ঘটিয়েছে। শেষ রক্ষা হলো না। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মেট্রো অঞ্চলের অভিযানে রাশেদাসহ ধরা পড়লো ঘটনায় জড়িত ছয় জনই। বাপ্পী খুনের ঘটনায় রাশেদা বেগমসহ (২৭) ছয়জনকে আটকের পর তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে খুনের কারণ সম্পর্কে বলেন পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মেট্রো) মো. মঈন উদ্দিন। এছাড়া সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরেও এ সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য অকপটে বর্ণনা করেন আসামি রাশেদা নিজেই। আটক হওয়া বাকি পাঁচজন হলো হুমায়ূন রশীদ (২৮), আল–আমিন (২৮), মো. পারভেজ প্রকাশ আলী (২৪), আকবর হোসেন প্রকাশ রুবেল (২৩) এবং জাকির হোসেন প্রকাশ মোল্লা জাকির (৩৫)। আটক ৬ জনকে আজ মঙ্গলবার আদালতে হাজির করে সাতদিনের রিমান্ড চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পিবিআই কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন।

প্রসঙ্গত, গত শনিবার দুপুরে নগরীর চকবাজার থানার পশ্চিম বাকলিয়া কেবি আমান আলী সড়কের বড় মিয়া মসজিদ এলাকার এন ইউ ভবনের নিচতলার একটি কক্ষ থেকে ওমর ফারুক বাপ্পীর হাত–পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০১৩ সাল থেকে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন বাপ্পী। আইন পেশার পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ওমর ফারুক বাপ্পী। তিনি বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র সহ সভাপতি ও বান্দরবান জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য ছিলেন। এ ঘটনায় শনিবার রাতে চকবাজার থানায় বাদি হয়ে হত্যা মামলা করেছেন বাপ্পীর বাবা আলী আহমদ। এতে রাশেদা বেগমসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়।

পূর্ব পরিকল্পিতভাবে খুন নাকি দুর্ঘটনা? : পিবিআইয়ের দাবি বাপ্পীকে খুন করা হয়েছে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বাসা ভাড়া নেওয়া, বাপ্পীকে আমন্ত্রণ জানানো, সহযোগীদের তৈরি রাখাসহ সবকিছু করা হয়েছে। তবে রাশেদা সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, বাপ্পী কাবিননামার টাকা দিতে চেয়েছে দুই লাখ। এটাকে ৫ লাখ / ১০ লাখ করার জন্য আমি তাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম । পরামর্শটা দিয়েছিল হুমায়ূন। কিন্তু ভয় দেখাতে গিয়ে তাকে মেরেই ফেলে।

সামাজিক স্বীকৃতি চেয়েছিল রাশেদা : ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর কল্পলোক আবাসিক এলাকা থেকে দুইশ পিস ইয়াবাসহ দেলোয়ার হোসেন ও রাশেদাকে গ্রেফতার করেছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় করা মামলায় দুজনই কয়েকমাস জেল খাটেন। তাদের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেছিলেন বাপ্পী। এক সময় ওই নারীকে জামিনে বের করে আনেন বাপ্পী। কিন্তু তার স্বামী তখন জামিন পাননি। মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতে আসা–যাওয়ার সুবাদে বাপ্পীর সাথে রাশেদার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। ২০১৫ সালের দিকে অনেকটা বাধ্য হয়ে রাশেদাকে গোপনে বিয়ে করে বাপ্পী। রাশেদার মতো তার মায়েরও একাধিক বিয়ে হয়েছিল। সর্বশেষ যে কাজী রাশেদার মায়ের বিয়ে পড়ান, সেই কাজীই বাপ্পীর সাথে রাশেদারও বিয়ে পড়ান। বিয়ের কাবিন নামায় দেনমোহরের টাকা ধার্য ছিল দুই লাখ। সম্প্রতি বাপ্পীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তার পরিবার মেয়ে খুঁজছিল। বিষয়টি জানতে পেরে রাশেদা সামাজিক ও পারিবারিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। বারবার চেষ্টা করেও বাপ্পীর কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে না পেরে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে রাশেদা। সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন বলেন, বাপ্পী গোপনে বিয়ে করে রাশেদাকে স্বীকৃতি দেননি। তিনি রাশেদার সঙ্গে সংসার করতে চান না।ঞ্জ তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ তৈরি হয়। অন্যদিকে রাশেদা তাকে ছাড়তে চান না।ঞ্জ তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। মামলার প্রে িতে আইনজীবী বাপ্পীকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং সে জাল ডিভোর্স পেপার জমা দিয়ে মামলা থেকে রেহাই পায়। এসব বিষয় থেকেই মূলত দ্বন্দ্ব এবং হত্যাকাণ্ড।

কাবিন নামার টাকা বাড়ানোর ফন্দি : বিয়ের পর থেকেই তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত দাম্পত্য কলহ চলছিল। ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি পাঁচলাইশ থানায় রাশেদা বেগম বাদি হয়ে বাপ্পীর বিরুদ্ধে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগ এনে মামলা করেন।। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বাপ্পীকে গ্রেফতার করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। পরে আদালত থেকে জামিন পান তিনি। ২০১৭ সালের এপ্রিলে কোতোয়ালী থানায় বাপ্পীও রাশেদার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিলেন। এ মামলায় রাশেদা ১৭ দিন জেল খাটেন। রাশেদা জানায়, হুমায়ূন তিন বছর ধরে আমার বন্ধু।ঞ্জ আমি তাকে বলেছি, বাপ্পীর জন্য তো মেয়ে খুঁজছে, আমি এখন কি করব ? এসময হুমায়ূন বুদ্ধি দেয়, তাকে টাকার অংক বাড়াতে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে ভয় দেখাতে হবে। একবার টাকার অংকটা বাড়িয়ে নিতে পারলে বাপ্পী রাশেদাকে স্বীকৃতি না দিয়ে পারবেন না। সিদ্ধান্ত নেয়, বাপ্পী যদি তাকে ছেড়েই দেয় তবে কাবিন নামার টাকা দুই লাখের পরিবর্তে দশ লাখ দিতেই হবে। সেই কৌশল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বন্ধু হুমায়ূনকে নিয়ে বাপ্পীকে খুন করে ফেলে রাশেদা, সঙ্গে ছিলেন আরো পাঁচজন।

বাসা ভাড়া নিয়েছিল রাশেদা ও হুমায়ূন : বড় মিয়া মসজিদের সামনে ইউ ভবনটির দারোয়ান মো. ইলিয়াস জানিয়েছিলেন, ২০ নভেম্বর মঙ্গলবার বিকালে এক নারী বাসা ভাড়া নিতে আসেন। এ সময় তার সাথে থাকা ছেলেটিকে তার ভাই বলে পরিচয় দেন। বাসায় তিনি স্বামী ও ছোটভাইকে নিয়ে থাকবেন বলে জানান। তার স্বামী চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী বলে পরিচয় দেন। বাসা পছন্দ করে অগ্রিম হিসেবে দুই হাজার টাকা দিয়ে যান। পরদিন সন্ধ্যায় দুইটি ভ্যানে করে কিছু বিছানাপত্র নিয়ে আসেন। জাতীয় পরিচয়পত্র চাইলে শনিবার দেবেন বলে জানান। পিবিআই ইন্সপেক্টর এনায়েত জানান, সেদিন বাসা ভাড়া নিয়েছিল রাশেদা–ই এবং ভাই বলে যাকে পরিচয় দিয়েছিল, সে ছিল হুমায়ূন। পুরো পরিকল্পনাটাই রাশেদা ও হুমায়ূন যৌথভাবে করেছে। রাশেদা এবং হুমায়ূন ছাড়া বাকি চারজন সিইপিজেডে পোশাক কারখানায় চাকরি করে। বাপ্পীকে ভয় দেখানোর জন্য তাদের হুমায়ূন নিয়ে গিয়েছিল। রাশেদা তাদের চিনত না বলে দাবি করেছে।

পরিকল্পনার বাস্তবায়ন : রাশেদা পুলিশকে জানায়, বাপ্পী প্রায় সময় তাকে ‘দুই পয়সার মেয়ে’ বলে সম্বোধন করত এবং তাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিত। কাবিননামা বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকা করার জন্য খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিতে রাশেদা তার বন্ধু হুমায়নকে নিয়ে পরিকল্পনা করে। ঘটনার দিন রাত ১০টার দিকে হুমায়ূন অন্য চারজনকে নিয়ে ওই বাসায় যায়। বাসায় ঢুকে রাশেদার বুকে ছোরা ধরার নাটক করেন। তখন বাপ্পী চিৎকার দিলে তার মুখ চেপে ধরে হাত–পা, মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বাপ্পীর আর জ্ঞান ফেরেনি। এ সময় মুখে পানি ছিটিয়ে তার জ্ঞান না ফেরায় হুমায়ূন বাপ্পীর কাছে থেকে স্বাক্ষর নেয়া সম্ভব নয় বলে জানায়। বাপ্পী যেন অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করতে না পারে সেজন্য রাশেদা তার পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়ার জন্য হুমায়ূনকে নির্দেশ দিলে সে তা করতে অপারগতা জানায়। বাকি চারজন রাজি হয়। রাশেদাকে নিয়ে হুমায়ূন বের হয়ে যায়। বাকি চারজন বাপ্পীর পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়। কাজ শেষে তার ছবি তুলে মুরাদপুরে রাশেদার সাথে দেখা করে এবং সে তাদের পাঁচ হাজার টাকা দেয়।

তবে পিবিআইয়ের আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বাপ্পী মারা গেছে নিশ্চিত হওয়ার পর রাশেদাকে নিয়ে হুমাযূন ছুটে বেরিয়ে যায়। বাবি চার জন তখন বুঝে উঠতে পারছিল না, তারা কী করবে। এ সময় তারা ভাবে রাশেদার উপর দোষ চাপানো গেলে তারা বেঁচে যাবে। রাশেদার যেহেতু বাপ্পীর উপর ক্ষোভ ছিল, তাই পুরুষাঙ্গ কাটলে সকলে রাশেদার দিকে সন্দেহের আঙুল তুলবে, এমন ভাবনা থেকেই ঐ কাজটি করে।

ঘটনার পর তাদের গন্তব্য : গ্রেফতার অভিযান পরিচালনাকারী টিমের সদস্য পিবিআইয়ের এএসআই (মেট্রো) তারেক হোসাইন জানান, রাত ১০টা থেকে ভোর রাতের মধ্যে হত্যাকান্ড সম্পন্ন করে সবাই একে একে বেরিয়ে যান। হুমায়ূনকে নিয়ে রাশেদা মুরাদপুর ও পরে বহদ্দরহাট বোনের বাসায় গিয়ে এক রাত থাকে। পরদিন দুজনে কুমিল্লার মিয়াবাজার গিয়ে একটি বাসা ভাড়া নেয়। হুমায়ূনের এক বন্ধু বাসাটি ঠিক করেছিল। সেখান থেকে রাত পৌনে ২টার দিকে সৌদিয়া বাসে করে ঢাকায় রওনা দেয়। ভোরে সায়দাবাদ বাস টার্মিনালে পৌঁছে। সেখান থেকে টঙ্গীতে চলে যায়। যার আশায় টঙ্গীতে গিয়েছিল, কাঙ্খিত সেই মানুষটির দেখা না পেয়ে হুমায়ূন ও রাশেদা আবারো কুমিল্লার মিয়াবাজারে ফিরে আসে। হত্যাকাণ্ডের পর পিবিআই মামলার তদন্তভার নিয়ে কুমিলার মিয়ার বাজার থেকে রাশেদা ও হুমায়ূনকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের তথ্য অনুযায়ী সোমবার বিকালে বাকি চার জনকে নগরীর ইপিজেড এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

পাঠকের মতামত: