ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

ভাগ্যবতীর কুদরতে ডাকে পাখি মাঝরাতে!

গোলাম মাওলা রনি ::

সেবার এক অদ্ভুত দাম্পত্য কলহ দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। দম্পতিটিকে আমি চিনতাম বহুকাল আগে থেকে।

তাদের দাম্পত্যের প্রেমময় রসায়ন, সন্তান-সন্ততি এবং সচ্ছলতা দেখে অন্য দম্পতিরা ঈর্ষা করতেন। স্বামীটি ছিলেন একটি বহুজাতিক কোম্পানির বড় কর্তা। দেশ-বিদেশের লেখাপড়া, রুচিশীল পোশাক-পরিচ্ছদ এবং সুদর্শন দেহসৌষ্ঠবের পাশাপাশি নম্রতা, ভদ্রতা ও সৌজন্যতায় তিনি ছিলেন অনন্য। তার স্ত্রী ছিলেন অনিন্দ্যসুন্দরী, সহজ-সরল পল্লীবালা। দুনিয়ার কোনো সাতপাঁচ বা নয়ছয় মহিলাকে স্পর্শ করত না। খুব কম কথা বলতেন এবং দেখা-সাক্ষাৎ হলে মিষ্টি করে মুচকি হাসি দিয়ে সামাজিকতা রক্ষার চেষ্টা করতেন।

হঠাৎ একদিন কীসে কী হলো বুঝতে পারলাম না। সুখী দম্পতিটির ঘর থেকে প্রচণ্ড হট্টগোল, ঝগড়া-ঝাঁটি এবং চিৎকার-চেঁচামেচি ও কান্নাকাটির শব্দ ভেসে এলো। এগিয়ে যেতেই স্বামী-স্ত্রী দুজনেই উচ্চৈঃস্বরে পরস্পরের বিরুদ্ধে খিস্তিখেউর করে আগন্তুকদের হতবিহ্বল করে দিতে লাগলেন।

প্রথমে ঝগড়ার আগামাথা কিছু বুঝতে না পারলেও কিছুক্ষণ পর অনুমান করা গেল যে, সহায়-সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে তারা ঝগড়া করছেন। স্ত্রীর দাবি, বিয়ের সময় তার স্বামীটি ছিলেন দীনহীন অসহায় এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাকে বিয়ে করার পর সংসারে সচ্ছলতা আসে এবং পরবর্তীতে স্বামীর ধনসম্পদ ফুলে ফেঁপে স্ফীত হতে হতে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়। অন্যদিকে তাকে বিয়ে দেওয়ার পর তার ধনী পিতা ধীরে ধীরে নিঃস্ব হতে থাকেন। জ্যোতিষীদের গণনামতে, মহিলাটি হলেন সাক্ষাৎ ভাগ্যলক্ষ্মী। তার কপালের কুদরতে স্বামীর আজ এত বড় উত্থান এবং তার অনুপস্থিতির কারণে পিতৃগৃহ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। সুতরাং স্বামীকে অবশ্যই তার সম্পত্তির অর্ধেক স্ত্রীর নামে লিখে দিতে হবে এবং একই সঙ্গে শ্বশুর পরিবারের ভরণ-পোষণের দায় গ্রহণ করতে হবে।

সেদিনের সেই অদ্ভুত ঝগড়া-ঝাঁটির কথা আজ বহুকাল পরে হঠাৎ করেই মনে পড়ল নানাবিধ কারণে। নারী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্ক, পরকীয়া এবং নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ইদানীং প্রায়ই পত্রপত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। বিষয়টি আমাকে নানাভাবে ব্যথিত ও মর্মাহত করে তুলেছে। আমি এখন সময় পেলেই নারী-পুরুষের অনাদিকালের সম্পর্ক নিয়ে ভাবী। বিয়ে-থা, বহুবিবাহ, পরকীয়া, ধর্ষণ, পয়সার বিনিময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন কিংবা সমঝোতার মাধ্যমে নারী-পুরুষের একত্র বাস বা লিভ টুগেদার নিয়ে হাজারো প্রশ্ন আমার মাথার মধ্যে নিত্য ঘুরপাক খায়। অসম বিয়ে অর্থাৎ রাজকন্যা কর্তৃক পিয়ন-ড্রাইভার-দারোয়ানকে পাত্র নির্বাচন অথবা রাজপুত্র কর্তৃক বুয়া-মুয়া, ঘুঁটে কুড়ানি থেকে রাস্তার পাগলি অথবা হিজড়ার পাণিপ্রার্থী হওয়ার নেপথ্য কারণ খোঁজার কাজে আমার মন-মস্তিষ্ক প্রায়ই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

উপরোক্ত বিষয়াদি ছাড়াও আমি আরও কিছু অসম সম্পর্ক নিয়ে গলদঘর্ম হয়ে পড়ি। কেন একজন ষাট-সত্তর বছর বয়স্ক বৃদ্ধের সঙ্গে ঘর বাঁধার জন্য কিছু তরুণী কুলহারা হয়ে পড়ে। অথবা বৃদ্ধরা কেন তার কন্যা অথবা দৌহিত্রীর সমবয়সী নারীর আকর্ষণে মান-সম্মান, অর্থবিত্ত, পদ-পদবি ইত্যাদি বিসর্জন দেন। পুরুষ কেন ঘরে সুন্দরী, গুণবতী এবং অভিজাত স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও গণিকালয়ে রাত কাটান। অন্যদিকে তরুণী থেকে বৃদ্ধা বয়সী একশ্রেণির নারী কেন লম্পট, লুটেরা ও চরিত্রহীন প্রকৃতির পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়েন! এসব বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার আগে অদ্ভুত দাম্পত্য কলহের পরবর্তী পর্বে কী হলো তা আপনাদের জানিয়ে দিই। সুখী দম্পতির অদ্ভুত কলহের বিষয়বস্তু জানার পর পাড়া-প্রতিবেশীরা যেন কৌতুক অনুভব করতে লাগলেন। তারা পরিস্থিতি হালকা করার জন্য সদলবলে তাদের ভাগ্যবতী লক্ষ্মী ভাবীর পক্ষ নিয়ে বলতে থাকলেন যে, এটা বড়ই অন্যায়। ভাইয়ের অবশ্যই উচিত অনতিবিলম্বে ভাবীর দাবি মেনে নেওয়া। এমন রাজটিকাযুক্ত স্ত্রী পাওয়ার পর কোনো পুরুষ যদি তাকে অবহেলা করে তবে কী কী অনিষ্ট হতে পারে তা নিয়ে নীতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে ফেললেন জনৈক প্রতিবেশী। এসব কথা শুনে ভাগ্যবতীর আবেগ বহুগুণে বেড়ে গেল। তিনি তার চোখের অশ্রুগন্থিতে সঞ্চিত সব অশ্রু বিসর্জন করতে গিয়ে ক্ষণে ক্ষণে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং কৃতজ্ঞ দৃষ্টি মেলে তার প্রশংসাকারী পুরুষদের দেখতে লাগলেন। অন্যদিকে ভাগ্যবতীর স্বামী লজ্জা, শরম ও অপমানে একেবারে পাংশুবর্ণ হয়ে পড়লেন। সেদিনের মতো ঝগড়া থামল এবং কয়েক দিন পর আমরা জানতে পারলাম যে, ভদ্রলোক তার যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি স্ত্রীর নামে লিখে দিয়েছেন। এই গল্পের পরবর্তী অংশ বর্ণনার আগে স্বামী-স্ত্রী সংক্রান্ত মহাকালের কিছু অমর কাহিনী সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বলা দরকার। আপনি যদি ইতিহাসের পাঠক হয়ে থাকেন তবে নিশ্চয়ই মহাভারতে বর্ণিত পঞ্চপাণ্ডব বা পাঁচ ভাইয়ের এক স্ত্রী সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে থাকবেন। পাঁচ রাজপুত্র দ্রৌপদী নামের অসাধারণ এক সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়ে যুগ্মভাবে তার স্বামিত্ববরণ করেন। পাণ্ডবদের সঙ্গে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কৌরবদের যখন দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হলো তখন কোনো একদিন কৌরব রাজকুমার দুর্যোধনের সঙ্গে জুয়ার আসরে পাণ্ডব রাজকুমার দ্রৌপদীকে বন্ধক রেখে জুয়া খেলা আরম্ভ করেন এবং পরিকল্পনার কূটকৌশলে হেরে গিয়ে পঞ্চভ্রাতা দ্রৌপদীকে দুর্যোধনের কাছে সমর্পণ করেন। ঘটনার একপর্যায়ে পাঁচ মহাবীর রাজকুমারের সামনে প্রকাশ্য রাজদরবারে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করে বিজয়ী দুর্যোধন তাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ফেলেন। পঞ্চ স্বামী স্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে যাননি, বরং মাথা নিচু করে নীরবে মহাকালের জুলুমকে মেনে নেন কেবল জুয়ার আসরের শর্ত পূরণের অঙ্গীকার রক্ষা করার জন্য।

দ্বিতীয় কাহিনীটি বিশ্বসুন্দরী হেলেনের। গ্রিক সাহিত্যের মহাকবি হোমার রচিত মহাকাব্য ইলিয়ড ও ডিসির নায়িকা হেলেন। হোমারের কাহিনীতে প্রাচীন গ্রিসের লাকোনিয়া রাজ্যের রাজা মেনিলাসের স্ত্রী হেলেনকে সবাই হেলেন অব স্পার্টা বা স্পার্টার হেলেন বলেই বিলক্ষণ চিনতেন। রাজ্যের তাবৎ সুখ-শান্তি, স্বামীসোহাগ এবং পিতা-মাতা ও ভাইদের সুনাম-সুখ্যাতি পায়ের নিচে দলিত-মথিত করে হেলেন তার পরকীয়া প্রেমিক এবং ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিসের হাত ধরে সমুদ্রপথে পালিয়ে যান মিসরে। মুখ রক্ষার জন্য হেলেনের স্বামী ও ভাইয়েরা প্রচার করেন যে, যুবরাজ প্যারিস হেলেনকে অপহরণ করে নিয়ে গেছেন। কাজেই তারা রাজ্যের সম্মান রক্ষার জন্য সদলবলে সর্বশক্তি নিয়োগ করে ট্রয় আক্রমণ করে পুরো নগর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেন। ফলে একটি নারীর জন্য প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম সেরা বৃহৎ ও সমৃদ্ধিশালী একটি নগররাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।

আলোচনার এই পর্যায়ে আমি উপরোক্ত দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে আজকের শিরোনাম, প্রাসঙ্গিক গল্প এবং এতদসংক্রান্ত বিষয়ে আমার চিন্তাভাবনার একটি সমীকরণ রচনার চেষ্টা করব যাতে সম্মানিত পাঠকরা একটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে অন্য অনুচ্ছেদের অন্ত্যমিল খুঁজে পান। দ্রৌপদীর ঘটনার মধ্যে শিরোনামের বিষয়বস্তু অনুধাবন করার জন্য আরও একটি কাহিনী বলা দরকার। দ্রৌপদী ছিলেন রাজকুমারী এবং সমসাময়িক দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় সুন্দরী রমণী। তার পিতা রাজা দ্রুপদ আপন কন্যার রূপ-যৌবনকে পণ্য বানিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন। পিতার সেই দুরভিসন্ধির কারণেই পরবর্তীকালে মহাভারতের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তিনি কন্যার রূপ-যৌবনের বেসাতি সাজিয়ে ভারতবর্ষে উন্মুক্ত নিলামের আয়োজন করেন। দ্রৌপদী নিজেও পিতার সেই দুরভিসন্ধির সহযোগী হয়ে ওঠেন। দেশ-বিদেশের রাজকুমাররা তলোয়ার হাতে জীবন বাজি রেখে দ্রৌপদীকে পাওয়ার জন্য ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে একজন অন্যজনকে পরাজিত করার নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেন।

দ্রৌপদীর পিতার আহ্বানে পঞ্চপাণ্ডব এবং কৌরব রাজকুমার দুর্যোধনও নিজ নিজ বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য প্রতিযোগিতার মঞ্চে দণ্ডায়মান হন। সবাইকে হারিয়ে বড় পাণ্ডব অর্জুন দ্রৌপদীকে জয় করে নিয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে আসেন। অর্জুনসহ তার পাঁচ ভাই তাদের মা রাজমাতা কুন্তীর কাছে দ্রৌপদীকে সমর্পণ করেন। চার পাণ্ডব তাদের মায়ের কাছে আফসোস জানিয়ে খেদোক্তি করে বলেন যে, আমরা পাঁচ ভাই একটি রসাল ফলের জন্য জীবন-মরণ যুদ্ধ করেছি এবং অবশেষে ফলটি বড় ভাই অর্জুনের হস্তগত হয়েছে। আরও একটি ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ এড়ানোর জন্য রাজমাতা তার সন্তানদের বলেন, এবার পাঁচজন মিলে রসাল ফলটি ভাগেযোগে শান্তিপূর্ণভাবে ভোগ কর।

মহাভারতের উপরোক্ত কাহিনীটি পর্যালোচনা করলে নারী-পুরুষের যৌনতা, দাম্পত্য সম্পর্কের ব্যারোমিটার এবং ধরন প্রকৃতি সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। একজন রূপবতী নারীর পুরুষ কিংবা নারী অভিভাবকরা সব সময়ই তার রূপ-যৌবনকে পণ্যের পসার বানিয়ে বাণিজ্য করতে ভালোবাসেন। অন্যদিকে, নারী নিজেও তার অন্যসব গুণের ওপরে রূপ-যৌবনকে প্রাধান্য দিয়ে জীবিকার উপকরণ বা হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেন। নারীদের মধ্যে বেশির ভাগ অংশ পুরুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের মূলধন হিসেবে যৌনতাকেই প্রধান পুঁজি মনে করেন। একাধিক পুরুষে নারীর লোভ বেশির ভাগ সময়ে গুপ্ত থাকলেও কখনো তা প্রকাশ্য রূপ নেয় এবং এ ক্ষেত্রে নারীরা সফল হলে নিজেদের রীতিমতো প্রতিষ্ঠান অথবা বিপণিবিতান বানিয়ে ফেলেন।   দ্রৌপদীকে পাঁচ ভাই ভাগ করে নিয়েছিলেন যাতে দ্রৌপদীরও সম্মতি ছিল। তিনি নিজেও পাঁচ ভাইকে সমানভাবে ভালোবাসতেন এবং প্রায় সম আবেগ নিয়ে কাছে পেতে চাইতেন। কাজেই পরকীয়ার নামে এ যুগের দ্রৌপদী এবং পঞ্চপাণ্ডবরা প্রায় একই কাজ করছেন। মাঝেমধ্যে শুধু ঝামেলা বেধে যায় যখন দুর্যোধনেরা বেপরোয়াভাবে হানা দেন অথবা দ্রৌপদীরা যখন পঞ্চপাণ্ডব ছেড়ে দুর্যোধনের দিকে হাত বাড়ান।

এবার হেলেন সম্পর্কে কিছু বলি। হেলেন তার আপন যৌবন এবং রূপের পসরা কেবল স্পার্টার রাজপ্রাসাদে আবদ্ধ রাখতে চাইছিলেন না। তার স্বামী রাজা মেনিলাস স্ত্রীর মতিগতি সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানতেন এবং তিনি আরও জানতেন তার বন্ধু এবং ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিসের ল্যাম্পট্য ও নারীপ্রীতি সম্পর্কে। তিনিই প্যারিসকে আমন্ত্রণ করে স্পার্টায় নিয়ে আসেন এবং হেলেনের সঙ্গে পরিচয় ও মেলামেশার সুযোগ করে দেন। উদ্দেশ্য ছিল, আপন স্ত্রীর রূপ-যৌবন বন্ধুকে দেখিয়ে নিজের সৌভাগ্য ও প্রাপ্তির ষোলকলা প্রমাণ করা। বন্ধুর মনে কামনার দ্রোহ জাগিয়ে তুলে আপন কাম চরিতার্থ করার মাধ্যমে এক ধরনের পৈশাচিক তৃপ্তি লাভের অদম্য আকাঙ্ক্ষা রাজা মেনিলাসকে তাড়িত করেছিল।

উপরোক্ত ঘটনা দুটি আমাদের মহাকালের দুটি যুগান্তকারী উদাহরণ। মানুষের যৌনলিপ্সা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীর অপকর্ম মেনে নেওয়ার দুরন্ত অভ্যাসের বাস্তব রূপ রয়েছে ঘটনাসমূহের মধ্যে। আমাদের সমাজের সাম্প্রতিক যৌন অপরাধসমূহ যথা পরকীয়া, ধর্ষণ, অবাধ যৌনাচার, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়লে আমরা সবাই সমস্বরে ছি ছি করে উঠি। আবার এসব দুষ্কর্ম করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে শাস্তির দাবিতে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলি। অথচ ঘটনার জন্য আমরাও যে অনেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী সে কথাটি ভাবী না, আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে আমাদের চোখের সম্মুখে আমাদের আশকারা পেয়ে এসব সামাজিক ব্যাধি যে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করেছে সে ব্যাপারে সতর্ক এবং সচেতন না হলে পরিস্থিতি যে দিন দিন আরও অবনতির দিকে যাবে তাতে কোনোরকম সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। আমরা আজকের নিবন্ধের একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার আমাদের আলোচ্য গল্পটির পরিণতির দিকে এগোনোর চেষ্টা করা যাক। স্বামীর সহায়-সম্পত্তি, অর্থকড়ি, ব্যাংক ব্যালান্স পাওয়ার পর সৌভাগ্যবতী স্ত্রী রাতারাতি নিজেক বদলিয়ে ফেলেন। প্রথমে তিনি নিজের নামটি জুলেখা বিবি থেকে জুলিয়া খানে রূপান্তরিত করে ফেললেন। বিউটি পারলার, ক্লাব, ঘরোয়া পার্টি করতে করতে অবাধ মেলামেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন। অন্যদিকে তার স্বামীটি নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে কেমন যেন ম্যান্দা ম্যান্দা প্রবৃত্তির ভাবলেশহীন প্রাণী হয়ে গেলেন। স্ত্রী যখন ক্লাবে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে অসামাজিক কর্মে মত্ত হয়ে পড়লেন তখন স্বামী অধিকতর পুণ্য লাভের জন্য দেবালয়ে দিনরাতের বেশির ভগ সময় ব্যয় করার পাশাপাশি ঘন ঘন তীর্থযাত্রা শুরু করেন।

জুলিয়া খানের জীবনযাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার ছেলেমেয়েরাও একই কায়দায় আধুনিকতার নামে অসভ্যতায় মেতে উঠলেন। তারা সারা দিন ঘুমান এবং রাত হলে জেগে ওঠেন। রাত যত গভীর হয় ততই তাদের উন্মাদনা বাড়তে থাকে। তারা তাদের প্রেমিক-প্রেমিকাদের বিভিন্ন সাংকেতিক নামে ডাকতেন। কারও নাম ময়না পাখি আবার কারও নাম টিয়া পাখি। এর বাইরে কোকিল-দোয়েল, শালিক, চড়ুই, দোয়েল-শ্যামা এবং ঘুঘুও ছিল বেশ কয়েকটি। মা-মেয়ের অভিসারের সঙ্গীরা প্রায়ই দুর্যোধনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জমিন পরিবর্তনের চেষ্টা করতেন যাদের তারা পেঁচা ও শকুন নামে অভিহিত করতেন। পাখিগুলোর নামে মোবাইলে সংশ্লিষ্ট প্রেমিকদের নম্বর সেইভ করা ছিল এবং তারা যখন গভীর রাতে ফোন দিতেন তখন কোকিল-ময়না-দোয়েল-শ্যামা ইত্যাদির কলরবে মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠত যা শুনে স্বামী বেচারার ধর্মকর্মের মনোযোগ আরও বহুগুণ বেড়ে যেত।

জুলিয়া খান এবং তার কন্যার অভিসার বেশ ভালোভাবে চলছিল। কারণ যে তথাকথিত ধনাঢ্য সমাজের বিতর্কিত অভিজাত পাড়ায় তারা বসবাস করতেন সেখানে মাঝরাতের পাখ-পাখালিদের হাঁকডাক সচরাচর ঘটনায় পরিণত হয়ে গেছে। ফলে এসব কর্মকে ঘৃণা করা বা বাধা দেওয়ার মতো কোনো পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজন তাদের ছিল না। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই ঘটল এক দুর্ঘটনা। জুলিয়া খান তার এক কোকিল বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে কন্যার এক শকুন বন্ধুর ওপর চড়াও হতে গিয়ে মহাবিপত্তি বাধিয়ে দিলেন। ফলে শকুন পাখি প্রথমে মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো এবং কয়েক দিন পর মারা গেল। অন্যদিকে জুলিয়া খান তার কোকিল বন্ধু, কন্যা এবং কন্যার টিয়া বন্ধু নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে কানাডা পালিয়ে গেলেন। [গল্পটি রূপক হিসেবে পরিবেশিত হলো যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সংযোগ নেই]।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত: