ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

রোহিঙ্গা অধ্যায়ঃ সেকাল ও একাল….

মু. ইসলাম ::
রোহিঙ্গারা মূলত পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আরিয়ান জনগোষ্ঠী। ২০১৬-১৭ রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের পূর্বে আনুমানিক ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারি যদিও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারিও রয়েছে।
অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের (বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের নিকট) চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।
৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও, বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে।এছাড়াও তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬-২০১৭ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমন-পীড়নের সম্মুখীন হয়েছে। ২৫ আগস্ট ২০১৭  মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে “রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের” হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে হত্যা, গুম, জ্বালাও পোড়া, ধর্ষণসহ দমনপীড়ন যা খোদ জাতিসংঘ “গণহত্যা” ও “জাতিগত নির্মূল” বলে আখ্যায়িত করেছে। ফলে প্রায় ৪ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিমরা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত উখিয়া-টেকনাফে বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে।

এককালে যাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি এখন তারাই বিশ্বের সবচয়ে ভাগ্যহত জনগোষ্ঠী। শত শত বছর ধরেই নির্যাতিত হয়ে আসছে এই জনগোষ্ঠী। তাদের ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস যে কাউকে নিঃসন্দেহে আবেগ আপ্লুত করবে। এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে; আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তী সময়ে চাটগাঁইয়া, রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মিশ্রণে এই জাতি ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আরাকানে মুসলমানরা বার্মিজ মগদের চেয়ে সুপ্রাচীন। বর্মিদের কয়েকশ বছর আগে থেকে সেখানে মুসলমানদের বসবাস। আরাকানি সূত্রে জানা যায়, আরাকানে দশ কিংবা  বারো শতকের আগে বর্মি অনুপ্রবেশ ঘটেনি। (Harvey, G E, History of Burma. p-137-313)
সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন পার্শ্ববর্তী উপকূলে আশ্রয় নেন। তাঁরা বলেন, ‘আল্লাহর রহমতের বেঁচে গেছি। ’ সেই ‘রহম’ থেকেই রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। কিন্তু আগে রোসাং ও রোয়াং শব্দ অধিক পরিচিত ছিল। (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া
১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে চলে আসেন। গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে তাঁকে বিতাড়নকারী বর্মি রাজাকে বিতাড়নে সহায়তা করেন। নরমিখলা ইসলাম কবুল করেন ও মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। এর ফলে সেখানে মুসলিম ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, কবি ও শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি পায়। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজকবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী। এ ছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুলমুলক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায়। (সূত্রঃ রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস, এন এম হাবিব উল্লাহ্)
আরাকানে রোহিঙ্গাদের বসবাসের ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। ইতিহাস বলছে, রোহিঙ্গারা আরাকানের ভূমিপুত্র।   ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। বাংলার প্রাচুর্যের কারণে যেমন ১৫০০ সালের শুরুতে এখানে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে, তেমনি ১৫০০ ও ১৬০০ সালে আরাকানে পর্তুগিজ ও ওলন্দাজদের আগমন ঘটে। ১৫৩১ সালে আরাকানের রাজা জেবুক শাহ পর্তুগিজ নৌসেনাদের সহায়তায় আরাকানে নৌবাহিনী গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল, মোগলদের থেকে আরাকানকে রক্ষা করা। নৌসেনা গঠনের উদ্দেশ্য ছিল যেহেতু মোগল মুসলিম সেনাদের মোকাবেলা, তাই জেবুক শাহ তার নৌবাহিনীতে আরাকানের মুসলমানদের পরিবর্তে মগদের স্থান দেন। কিন্তু পরে এরা মানবিকতাবিবর্জিত হিংস্র জলদস্যুতে পরিণত হয়।
আরাকানের পতনকাল শুরু হয় ১৬৬০ সালে আরাকানের রাজা চন্দ্র সু ধর্মা কর্তৃক মোগল রাজপুত্র শাহসুজাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে আরাকানে বিরাজ করে অস্থিরতা। মাঝখানে শান্তি ফিরে এলেও আরাকানি সামন্ত রাজাদের মধ্যে কোন্দল দেখা দেয়। সে সুযোগে ১৭৮৪ সালে বর্মি রাজা ভোধাপোয়া আরাকান দখলে নিলে আরাকানিদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। ১৮২৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি বার্মা দখল করলে দীর্ঘ ১০০ বছর পর্যন্ত আরাকানিরা অনেকটা স্বস্তিতে ছিল। কিন্তু ১৯৪২ সালে আরাকান জাপানিদের অধীনে চলে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মায় জাপানি সেনাদের দ্বারা এক লাখ ৭০ হাজার থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। নিহতদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যা ছিল মুসলমান। অবশেষে ১৯৪৫ সালে আবার ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে বার্মা। কিন্তু স্বাধীনতার মাধ্যমে বার্মা ব্রিটিশমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবে আরাকানের ওপর হত্যা, নির্যাতন আর উচ্ছেদে মেতে ওঠে বর্মিরা। আরাকানবাসীদের বহিরাগত আখ্যা দিয়ে শুরু করে চরম হত্যাযজ্ঞ। বলা যায়, বার্মার স্বাধীনতা আরাকানের রোহিঙ্গাদের জন্য বয়ে আনে অভিশাপ।
‘রোহিঙ্গাদের উৎস ও বিকাশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘রাজা ভোধাপোয়া আরাকান দখল করে বার্মার সঙ্গে যুক্ত করার আগে ১৪০৪ সাল থেকে ১৬২২ সাল পর্যন্ত ১৬ জন মুসলিম রাজা আরাকান শাসন করেন। ’
১৭৮২ সালে ‘থামাদা’ আরাকানের রাজধানী ‘ম্রোহং’ দখল করে নিজেকে রাজা ঘোষণা করে। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত স্বাধীন আরাকান রাজ্য এরপর একেবারে ভেঙে পড়ে।
১৭৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর বার্মার রাজা ভোধাপোয়া আরাকান আক্রমণ করে আরাকানকে বার্মার একটি প্রদেশে পরিণত করেন। সে সময় দুই লক্ষাধিক রাখাইনকে হত্যা করা হয়। পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়, যাতে এ জাতির পুনরুত্থানের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, জিন্নাহ আরাকানের ব্যাপারে সঠিক ভূমিকা গ্রহণ করলে আজ রোহিঙ্গাদের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে আরাকান মিয়ানামার থেকে আলাদা হতে চেয়েছিল। কেননা ঐতিহাসিকভাবে আরাকান মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অংশ ছিল না। ব্রিটিশ উপনিবেশে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) সঙ্গে একীভূত হতেও মত দেয় আরাকান নেতৃত্ব। ১৯৪৬ সালে গঠন করে ‘আরাকান মুসলিম লীগ’। কিন্তু জিন্নাহর ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আরাকান বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি। পারেনি তার স্বাধীন অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত না করলেও সে সময় তাদের স্বাধীন থাকার সুযোগ করে দেওয়া যেত।

মু. ইসলাম
সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি)
ইলিশিয়া জমিলা বেগম উচ্চ বিদ্যালয়।

পাঠকের মতামত: