ছোটন কান্তি নাথ, কুতুপালং থেকে ::: হঠাৎ প্রবল বর্ষণে চারদিকে মাটি কর্দমাক্ত হয়ে পড়ায় কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রোহিঙ্গারা। বৃষ্টির মধ্যেই গতকাল সকালে এক শিশুকে বুকে ও আরেক শিশুকে হাতে ধরে খাবারের সন্ধানে বের হয়ে পড়েন বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে (পুরাতন) ঠাঁই পাওয়া লালজান বেগম। কিন্তু এখানে–ওখানে গিয়ে কারো কাছ থেকে কোনো সহায়তা না পেয়ে শূন্যহাতেই বস্তিতে ফিরতে হয়েছে তাকে। পরে পার্শ্ববর্তী এক রোহিঙ্গা মহিলা রান্নার জন্য তাকে তিন পোয়া চাল দেন। কিন্তু প্রবল বৃষ্টিতে লালজানের ঝুপড়ি তলিয়ে যাওয়ায় সেখানে রান্না করে খাওয়া তো দূরে থাক এক মুহূর্তও তিনি অবস্থান করতে পারছিলেন না। তাই সকাল থেকেই সাত সন্তানসহ না খেয়ে ছিলেন লালজান। শুধু লালজান নয়, একই দুর্ভোগ ছিল এখানে পাহাড়ে ঝুঁপড়ি ঘরে অবস্থানকারী লাখো রোহিঙ্গার। আর ঝুঁপড়ি ঘরে এখনো যাদের ঠাঁই হয়নি তারা পড়েছেন আরো বেকায়দায়। কোলের দুগ্ধ শিশু এবং হাতের কাছের আরো ৬–৭ সদস্যকে নিয়ে কী যে দুর্ভোগে তারা দিন কাটাচ্ছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বলির বাজারের তুলাতলী এলাকার নুরুল কবিরের স্ত্রী লালজান বেগম (৩৫)। ২৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা তার স্বামীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। এর পর সাত সন্তানকে (৪ ছেলে ও ৩ মেয়ে) নিয়ে সাতদিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেন। এখানে আসার পর উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে (পুরাতন) আশ্রয় পান। কিন্তু সাত সন্তানের জন্য প্রতিদিন দুই বেলা খাবার যোগাড় করতে তাকে ভিক্ষা করতে হয় মানুষের কাছে।
রোহিঙ্গা নারী লালজান বেগম গতকাল রবিবার দুপুরে বলেন, ‘এখানে আসার পর এক ব্যক্তির কাছ থেকে মাত্র তিন কেজি চাল পেয়েছিলাম। এরপর আর কারো কাছ থেকে কোনো ধরণের সহায়তা পাইনি। এই অবস্থায় ভিক্ষে করে যা পাই তা দিয়ে সন্তানদের একবেলা খাওয়াচ্ছি। যে দিন কিছুই পাই না সেদিন না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।’
লালজান বেগম আরো বলেন, ‘শনিবার দিবাগত রাতে হঠাৎ প্রবল বর্ষণ শুরু হলে বালুখালী রোহিঙ্গা বস্তিতে ঠাঁই হওয়া ঝুঁপড়ি ঘরের সবকিছুই ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। তার ওপর পাহাড়ের আঠালো কাদা মাটিতে একাকার হয়ে পড়ে সবকিছু। সাথে ঘরে থাকা কাপড়–চোপড়, ঘুমানোর বিছানাসহ সবকিছুই ভিজে এবং কাদামাটিতে একাকার হয়ে পড়েছে।’
কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের পাশে টাওয়ার এলাকায় বনভূমিতে ঝুঁপড়ি ঘরে থাকছেন রোহিঙ্গা যুবক আবদুস শুক্কুর (৩০)। তার রয়েছে মা–বাবা, স্ত্রী, চার সন্তানসহ ১০ সদস্য। ১৮ দিন আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর লেমশী থেকে এখানে পালিয়ে আসেন। কিন্তু টাওয়ার সংলগ্ন বনভূমির পাদদেশে বানানো ঝুঁপড়ি ঘর শনিবার রাতের প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে যায়। আবদু শুক্কুর বলেন, ‘মংডুর লেমশীখালীতে আমার ১৭ কানি ফসলি জমি ছিল। সেখানে ১২ কানিতে ধান উৎপাদন এবং পাঁচ কানিতে বাদামের চাষ করেছিলাম। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং রাখাইন সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে এখানে পালিয়ে আসার সময় ৫০ কেজির মতো বাদাম নিয়ে আসি। সেখান থেকে শনিবার বিকেলে ২০ কেজি বাদাম বিক্রি করে পাই ২০০০ টাকা। এছাড়া এখানে এক ব্যক্তি আমার স্ত্রীকে ২০০ টাকা সাহায্য দেয়। সেই ২২০০ টাকা দিয়ে একটি চালের বস্তা কিনেছিলাম কয়েকদিন খাওয়ার জন্য। কিন্তু প্রবল বৃষ্টিতে সেই চালও ভিজে গেছে। এখন ভিজে যাওয়া চাল রোদে শুকাচ্ছি।
সরজমিন কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কোথাও তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই বৃষ্টির পানিতে কর্দমাক্ত হয়ে পড়েনি। আর কাদামাটিতে চলাফেরা করতে গিয়ে রোহিঙ্গা শিশু, নারী–পুরুষ ও বৃদ্ধরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। বৃষ্টির পানিতে কোথাও কোথাও হাঁটু পরিমাণ কাদা হয়ে গেছে। সেখানে স্বাভাবিকভাবে পায়ে হাটাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তার ওপর ঝুপড়ি ঘরের ভেতরের মাটিও কর্দমাক্ত হয়ে পড়ায় দুর্ভোগের শেষ নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের কবল থেকে বাঁচতে ২৫ আগষ্টের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিনই নতুন করে আসছে রোহিঙ্গারা। এর মধ্যে আনুমানিক অর্ধেক রোহিঙ্গার জায়গা হয়েছে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। বাকি অর্ধেক রোহিঙ্গা এখনো সড়কের ধারে অথবা আত্মীয়–স্বজনের কাছে থাকছে। আবার অনেকে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছে। এই অবস্থায় বৃষ্টিপাত হওয়ায় তাদের দুর্ভোগের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এতে বেশি বেকায়দায় পড়েছে কোলের শিশু, কিশোরি থেকে শুরু করে বয়স্করাও।
এখনো বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ বিতরণ : ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোকে শনিবার থেকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসে প্রশাসন। এর পরেও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কুতুপালং এবং বালুখালী শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ বিতরণ করছে। ত্রাণ বিতরণে শৃঙ্খলা ফেরাতে উখিয়ার প্রবেশপথে মহাসড়কে পাহারা বসানো হয়। তারপরেও ত্রাণবাহী কিছু যানবাহন বিকল্প পথ দিয়ে মহাসড়কে ঢুকে পড়ছে। এতে ত্রাণবাহী গাড়ি দেখলেই অভুক্ত রোহিঙ্গা শিশু ও নারী–পুরুষ দৌঁড়ে যাচ্ছে। গতকাল দুপুরেও ত্রাণবাহী একটি কাভার্ড ভ্যান দেখে সেখানে ছুঁটে যায় অসংখ্য রোহিঙ্গা। এ সময় ভ্যান থেকে খাবার প্যাকেট ছুঁড়ে মারা হয়। এতে অনেক খাবারের প্যাকেট কাঁদামাটিতে পড়ে যায়। পরে সেসব প্যাকেটও তুলে নেয় তারা।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাজী আবদুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরাতে জেলা প্রশাসনের চেষ্টার কমতি নেই। সামান্য লোকবল নিয়ে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে। বিশেষ করে জেলা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো ত্রাণবাহী গাড়ি গিয়ে যাতে শিবির এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে কক্সবাজার–টেকনাফ মহাসড়কের উখিয়ার প্রবেশমুখে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। এতে সুফলও মিলছে। কিন্তু বিকল্প পথ দিয়ে মহাসড়কে ঢুকে পড়ে দু–একটা গাড়ি। সেই গাড়ি থেকে রান্না করা খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে এভাবে যাতে আর না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।’
নিত্যপণ্য এবং হাতে বানানো খাবারের ব্যাপক চাহিদা : উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির এলাকায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে নিত্যপণ্য। এমনকি হাতে বানানো খাবারেরও ব্যাপক চাহিদা থাকায় সহসা মিলছে না সেই খাবার। খাবারের দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় রোহিঙ্গাদের। এতে স্থানীয় লোকজনকে খাবার নিয়ে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। কোনো কোনো দোকান থেকে খাবার সংগ্রহ করতে লাইন ধরতেও দেখা গেছে।
কুতুপালং এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা শাহ আলম বলেন, ‘সকাল সাড়ে দশটার দিকে একটি খাবারের দোকানে গিয়েছিলাম ৫টি পরোটা কিনতে। কিন্তু ওই দোকানে গিয়ে দেখি সেখানে দীর্ঘ লাইন পড়ে গেছে খাবার সংগ্রহের জন্য। পরোটার কারিগর চুলোর ওপর পাত্রের মধ্যে একটি পরোটা ছেঁকার জন্য দিলে সেই পরোটা তৈরির অর্ধাবস্থায় কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। কার আগে কে পরোটা নেবে সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।’
আরেক বাসিন্দা দিলদার হোসেন বলেন, ‘লাখ লাখ রোহিঙ্গার চাপে আমরা যারা এখানকার স্থানীয় তারা সংখ্যালঘু হয়ে গেছি! অতিরিক্ত রোহিঙ্গার চাপে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও আকাশচুম্বি। যে সবজি ২০–৩০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই সবজির দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণে ঠেকেছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে স্থানীয় লোকজনের বসবাস করা দূরূহ হয়ে পড়বে। অনেকে ইতোমধ্যে অন্যত্র বাসাবাড়িতে চলে যাচ্ছেন।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী ও মুক্তির ত্রাণ বিতরণ : বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর অর্থায়নে এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মুক্তি কক্সবাজার এর ব্যানারে ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ১৬ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের মাঝে ২৫ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। এর ফলে অভুক্ত রোহিঙ্গা পরিবারগুলো দুই বেলা স্বাচ্ছন্দেখেতে পারছে। ত্রাণ বিতরণের সময় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর (ডব্লিউএফপি) স্থানীয় কর্মকর্তা শুভংকর চন্দ্র দাশ এবং মুক্তি কক্সবাজার এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহমুদ শাহীন উপস্থিত ছিলেন। তারা জানান, সোমবার (আজ) থেকে বাকি ১৪ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের মাঝে একইভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হবে।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু : কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে একদিন থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের জন্য বিশেষ ইপিআই কর্মসূচীর অধীনে ১৬টি ইপিআই কেন্দ্র স্থাপন ও ৩৬টি মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে একদিন থেকে ৫৯ মাস বয়সী ১ ল ২০ হাজার শিশুকে ইপিআই কর্মসূচীর আওতায় আনা হচ্ছে। এছাড়াও ৮৭০০ শিশুকে হাম–রুবেলা টিকা প্রদান এবং ৪৯৮৩ জন শিশুকে পোলিও টিকা দেয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. আবদুস সালাম জানান, গত শনিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রী মো. নাসিম উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে গেছেন। এ সময় তিনি শরণার্থী শিবিরগুলোতে মেডিকেল টিম স্থাপনসহ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করতে নির্দেশ দেন। তারই নির্দেশনা মোতাবেক এখানকার স্বাস্থ্য বিভাগের সকল কর্মকর্তা–কর্মচারী ও ডাক্তারদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। তারা সকলেই এখানে নেয়া বিশেষ কর্মসূচীসহ চিকিৎসা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন।
আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থার ত্রিপল বিতরণ : আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) পক্ষ থেকে গতকাল রবিবার বিকেলে একসঙ্গে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের মাঝে ত্রিপল ও রশি বিতরণ করা হয়েছে। এতে শনিবার দিবাগত রাত থেকে প্রবল বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগে থাকা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর মধ্যে ৫ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার এই সহায়তা পেল।
গতকাল বিকেলে সহায়তা হিসেবে ত্রিপল ও রশি পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন রোহিঙ্গা নাগরিক মোহাম্মদ কালু। এ সময় তিনি বলেন, ‘বৃষ্টিতে শনিবার রাতভর ভিজেছি। নষ্ট হয়ে গেছে ঝুপড়ি ঘরে থাকা কাপড়–চোপড় ও বিছানা। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ছিলাম। এই অবস্থায় ত্রিপল পাওয়ায় আল্লাহর কাছে শোকরিয়া করছি।
পাঠকের মতামত: