ঢাকা,শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

সড়কে মৃত্যুর মিছিল: চট্টগ্রাম-টেকনাফ সড়কে ৪২ দিনে ৬৫ জনের মৃত্যু

road acciশীত মৌসুমে লবণবোঝাই ট্রাক থেকে পানি পড়ে মহাসড়ক পিচ্ছিল, আঁকা-বাঁকা পথ দিক নিদের্শনাহীন, সড়কের ওপর বাজার ও অদক্ষ চালকের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। সম্প্রতি কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে দুর্ঘটনা। গত ৪২ দিনে এই দুই সড়কে শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ৬৫ জন। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০০ জন। আহতের অধিকাংশই বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব। সংঘটিত দুর্ঘটনার ৮০ ভাগ ঘটেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ায়। তবে সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা সংশ্লিষ্ট কেউ দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেনি। একাধিক মাধ্যমে এসব তথ্যে জানা গেছে।
জানা যায়, বিশেষ করে চকরিয়া সড়কে দুর্ঘটনার মাত্রা অনেক ভয়াবহ। প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়কে ঘটছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। এমনকি একই দিনে ঘটছে একাধিক দুর্ঘটনাও। প্রতিটিতে ঘটছে প্রাণহানি। মাত্রারিক্ত সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় লোকজন চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এখন অনেকে গাড়িতে করে কোথাও যেতে ভয় করছে। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটে চললেও তার কারণ চিহ্নিতকরণ ও তার রোধে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না সংশ্লিষ্টদের।
জানা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণাংশ থেকে চকরিয়ার খুটাখালী পর্যন্ত প্রায় ১শ ১৫ কিলোমিটার সড়কের ৫০টির অধিক স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ১৫টির অধিক স্থানে সড়কের ওপর হাটবাজার রয়েছে। অন্যদিকে কক্সবাজার-টেকনাফ ৭৯ কিলোমিটার সড়কের ৩১টি বাঁকের অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে দিক নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড নেই।
এবিষয়ে রামু ক্রসিং হাইংয়ে থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো অদক্ষ চালক এবং ওভার স্পিডে গাড়ি চালানো। এছাড়া কক্সবাজারের সড়কগুলো আঁকা-বাঁকা। অন্যদিকে শীত মৌসুমে লাবণবোঝাই ট্রাকের কারণে সড়কগুলো পিচ্ছিল হয়ে যায়। এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে। রাস্তায় যে নিয়মে লবণবোঝাই ট্রাকগুলো চলাচলের নিয়ম রয়েছে, এই নিয়মে চলছে না।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এবিষয়ে গাড়ি মালিকদের সাথে পরামর্শ করা হয়। মহাসড়কে ছোট যানবাহনগুলো দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে তিনি জানান। সম্প্রতি দুর্ঘটনাগুলোকে তিনি লবণের কারণে পিচ্ছিল সড়ককে দায়ী করেন জেলা প্রশাসক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১১ ডিসেম্বর রামুর রশিদ নগরে যাত্রীবাহী বাস উল্টে নারীসহ চার জন নিহত হন। এঘটনায় আহত হন আরো ৩৮ জন। একই দিন চকরিয়ায় টমটম উল্টে একজন নিহত হন। ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া ফাঁসিয়াখালী এলাকায় বাস-মাহিন্দ্রার মুখোমুখি সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। আহত হন ১০ জন। ২ জানুয়ারি কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের রামুর পানেরছড়ায় একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হন। ১০ জানুয়ারি ঈদগাঁওতে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় একজন নিহত হন। ১১ জানুয়ারি কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের চেইন্দা এলাকায় ইটবোঝাই ট্রাকের ধাক্কায় এক পথচারী নিহত হন। ১৬ জানুয়ারি ঈদগাঁওতে বাস খাদে পড়ে ১০ জন আহত হন। ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ঈদগাঁওয়ে ম্যাজিক গাড়ির ধাক্কায় এক শিশু নিহত হন। ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কক্সবাজার সদরের ইসলামপুরে ম্যাজিক গাড়ির ধাক্কায় টেকনাফের এক শিশু নিহত হন। ১৯ জানুয়ারি চকরিয়ার চকরিয়া-মহেশখালী সড়কে বাটাখালী এলাকায় সিএনজি-ম্যাজিক গাড়ি মুখোমুখি সংঘর্ষে এক ব্যবসায়ী নিহত হন। এই ঘটনাসহ আরেক দুর্ঘটনায় মোট আটজন আহত হন। একইদিন একই স্থানে ম্যাজিক গাড়ির ধাক্কায় এক বৃদ্ধ নিহত হন।
অন্যদিকে, একই দিন কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকায় ডাম্পারের ধাক্কায় মোটরসাইকেলে আরোহী পরিবহন শ্রমিকনেতা খোরশেদ আলম নিহত হন। ২০ জানুয়ারি চকরিয়ায় দু’টি সড়ক দুর্ঘটনায় দু’জন নিহত হন, আহত হন চারজন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের হারবাং এলাকায় ম্যাজিক উঠতে গিয়ে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় একজন নিহত হন। এসময় আহত হন আরো চার যাত্রী। অপরদিকে চকরিয়ার চকরিয়া-মহেশখালী সড়কের মাইজঘোনা এলাকায় মোটরসাইকেলে ধাক্কায় এক শিশু নিহত হয়। ২১ জানুয়ারি চকরিয়ার পূর্ব বড়ভেওলায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় এক বৃদ্ধ নিহত হন। ২৫ জানুয়ারি চকরিয়ায় ডাম্পারের ধাক্কা মাইক্রোবাসের যাত্রী এক শিশু নিহত ও আহত হয় ছয়জন। ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ের রামু নাদেরুজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে বাসের ধাক্কায় এক যুবক নিহত হন। ১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা পাগলিরবিল এলাকায় মাইক্রোবাস ও তেলবাহী ভাইসারের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক কিশোর নিহত হয়েছে। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ১০ জন। ২ ফেব্রুয়ারি চকরিয়ার হারবাংয়ে এসিবাস-নোহা সংঘর্ষে তিন যাত্রী নিহত, আহত হন ১৫ জন। একই দিন রামু-মরিচ্যা সড়কে পিকআপ চাপায় মারা যায় এক স্কুলছাত্র। একই সময় কক্সবাজার শহরের কানাইয়া বাজার রাস্তা পার হওয়ার সময় দ্রুতগামী টমটমের ধাক্কায় মিথিলা নামে এক শিশু গুরুতর আহত হয়। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ ফেব্রুয়ারি মারা যায় মিথিলা। ২৪ জানুয়ারি পেকুয়ার টইটংয়ে নসিমন গাড়িচাপায় এক স্কুলছাত্র নিহত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার উপজেলার হারবাং ইনানী রিসোর্ট এলাকায় পিকনিক বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ যাত্রী। অপরদিকে রাতে টেকনাফে পথ পার হয়ে চট্টগ্রামগামী সুগন্ধা বাসের ধাক্কায় পারভীন আক্তার (১৩) নামে কিশোরী মারা যায়।
হাইওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪২ দিনে চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৫১ জন। এরমধ্যে চকরিয়ায় ১৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৪ জন। অন্যদিকে কক্সবাজার টেকনাফ সড়কে ১৯টির মতো ঘটে দুর্ঘটনা। এতে নিহত হয়েছেন ৯ জন। এছাড়া উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজার শহরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচজন মতো নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে।
নিরাপদ সড়ক চাই এর ওপর কর্মরত এনজিও সংস্থা উখিয়ার ব্র্যাক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার-টেকনাফ ৭৯ কিলোমিটার সড়কের ৩১টি বাঁকের অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে দিক নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড নেই।
উখিয়ার ট্রাক মালিক শ্রমিক সমিতির সভাপতি মো. শাহজাহান জানান, পর্যটন সড়ক হিসাবে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ককে যতটুকু উন্নয়ন করা উচিত সড়ক ও জনপথ বিভাগ তা করেনি। খানা খন্দকসহ সংকুচিত এ সড়কে পাশের জায়গাগুলো বেদখল হয়ে যাওয়ার কারণে সব ধরনের যানবাহন চলাচল করতে হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে।
কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রানা প্রিয় বড়–য়া বলেন, লবণবোঝাই ট্রাক থেকে পানি পড়ে সড়কের স্থায়িত্ব নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বেশি। বিশেষ করে রাতে ও সকালে সড়কগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বেশি হয়। সুত্র পূর্বকোণ

পাঠকের মতামত: