ঢাকা,মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪

জেলাজুড়ে নতুন রোহিঙ্গা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে

rohinga2অনলাইন ডেস্ক :::
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে এখনো। প্রাণে বাঁচতে প্রতিদিন নাফ নদী পেরিয়ে নতুন করে বংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। এতে দিন দিন রোহিঙ্গা সংখ্যা বেড়েই চলছে। মিয়ানমারে নতুন ঘটনার পর থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশসহ কক্সবাজারের মানুষ। এমনিতে আগে থেকে উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গাদের চারটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে। এরপরও নতুন করে ঢুকছেন রোহিঙ্গা। এর সাথে বড় বড় অপরাধের সাথে জড়িত রয়েছে রোহিঙ্গারা।
টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, রোববার ভোরে নাফ নদী সংলগ্ন তিনটি পয়েন্ট দিয়ে শূন্যরেখা অতিক্রম করে রোহিঙ্গাভর্তি ৬টি নৌকা অনুপ্রবেশ চেষ্টাকালে তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে ঠেকানো হয়েছে। তাছাড়া নাফ নদীর যেসব পয়েন্ট দিয়ে  রোহিঙ্গারা বেশি প্রবেশের চেষ্টা করছে সেসব পয়েন্টে বিজিবির নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে গত শুক্রবার কক্সবাজারের টেকনাফে এক সংবাদ সম্মেলনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলেছেন, স্থানীয় দালালদের সহায়তায় কিছু  রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এটা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। তবে কি পরিমাণ  রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে তার পরিসংখ্যান বিজিবির কাছে নেই বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, বিজিবির একার পক্ষে ৬৩ কিলোমিটার জলসীমাসহ ২৭১ কিলোমিটার জলপথের শতভাগ নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নই। যেসব স্থলপথে বিজিবির টহল দিতে পারছে না সেসব পয়েন্ট দিয়ে এলাকায় কিছু স্থানীয় দালালরা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকাচ্ছে। ওই পয়েন্টগুলোতে বিজিবির বাড়তি নজরদারি রয়েছে।
চলতি বছরের ৫ জুলাই মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বাড়ি ঢুকে টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক ইউপি মো. সিরাজুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এসময় আরও দু’জনকে গুলিবিদ্ধ করে। এ ঘটনায় রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিমকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করা হয়। এতে ডাকাত আদুল হাকিমকে আসামি করায় মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে মো. ফারুককে হত্যা করার হুমকি দিয়ে আসছে।
চলতি বছরে গত ১৩ মে রাতে রেজিষ্ট্রার্ড টেকনাফ নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের আনসার ক্যা¤েপর হামলা চালিয়ে আনসার কমান্ডার আলি হোসেনকে গুলি করে করা হয়। এসময় হামলাকারীরা ১১টি অস্ত্র ও ৬শ রাউন্ড গুলি লুট করেছিল। দীর্ঘদিনেও সেই লুণ্ঠিত অস্ত্রসস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি। এ ঘটনার ব্যাপারে  টেকনাফ থানায় দায়ের করা মামলায় সন্দেহজনক অনেককেই আটক করা হয়েছিল। মামলায় আটক একজন স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল আবছার নামে এক ব্যক্তি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে  আরএসও’র সক্রিয় সদস্যরাই পরিকল্পিতভাবে আনসার ক্যা¤েপ হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট করে মিয়ানমারে নিয়ে যায় বলে দাবি করেন তিনি। এঘটনার সঙ্গেও রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম জড়িত ছিল জানান স্থানীয় লোকজন। গত ২০১৫ সালে ১২ জুন পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত মো. সেলিম ওরফে মুন্ডি সেলিমকেও গুলি করে হত্যা করেছিল রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম। এতে তাকে প্রধান আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করা হয়। এছাড়া বর্তমানে গত তিন দিন ধরে রোহিঙ্গা মাঝি মো. শফিউল্লাহ ও তার  ছেলেকে পাহাড়ের ভেতর জিম্মি করে রেখেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। টেকনাফের আবদুল লতিফের ছেলে নুরুল কবির, সিএনজি ড্রাইভার মো. আলী হত্যা করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। তার রয়েছে এক বিশাল নেটওয়ার্ক!
সূত্রমতে, মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ১৯৯১ সালের শেষের দিকে পালিয়ে আসে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা উখিয়ার টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। এ অবস্থা উখিয়া টেকনাফের স্বাভাবিক পরিবেশের ওপর চরম প্রভাব ফেলে। বর্তমানে রোহিঙ্গা শিবিরের লক্ষাধিক  রোহিঙ্গার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন ছয়-সাতজন অস্ত্রধারীরা। শরণার্থী ক্যা¤েপ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষ। বিশেষ করে কক্সবাজার জেলার মানুষ খুব বেশি নিরাপদ মনে করছেন না নিজেকে। কেননা রোহিঙ্গারা খুব ভয়ঙ্কর!
রোহিঙ্গা প্রতিরোধের সভাপতি মো. কায়সার পারভেজ জানান, রোহিঙ্গা সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক নানা অপরাধেরও ঘাঁটি হয়ে উঠেছে টেকনাফ। উপকূলীয় এলাকার অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ জলদস্যু চক্র। এর মুলহোতা হচ্ছে রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম। সে নাফনদী পার হয়ে এপারে ওপারে গিয়ে নানার অপরাধমূলক কর্মকা- ঘটিয়ে আসছিল। তার একটি রয়েছে বড় নেটওয়ার্ক। তারা দেশি-বিদেশি সব ধরনের জাহাজে দস্যুতা ও লুটপাট করে থাকে। ইয়াবা বাণিজ্য থেকে শুরু করে অপরাধ-অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
স্থানীয় কয়েকজন সচেতন নাগিরিক জানান, টেকনাফে ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে লক্ষাধিক  রোহিঙ্গা। তারা বাংলাদেশি তরুণী বিয়ে করে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে চালিয়ে যাচ্ছে নানান অপরাধ।  রোহিঙ্গারা রীতিমতো সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক ব্যবসার পাশাপাশি আদম পাচারের ঘৃণ্য বাণিজ্যও চালিয়ে আসছে তারা। বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে। এমনকি তারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে।  হত্যাকা-, চুরি, ডাকাতি, অপহরণসহ অন্যান্য অপরাধেও তারা জড়িত বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত করেছেন। টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালংয়ের শরণার্থী ক্যা¤প ও সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল মজিদ জানান, রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিমকে ধরার জন্য পুলিশ বেশ কয়েকবার পাহাড়ে অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে সে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা করলে তাকে দ্রুত ধরা সম্ভব হবে এবং বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বিভিন্ন অপরাধামূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া পুলিশের অভিযান জোরদার করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
বর্তমানে সাড়ে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তার মধ্যে এক লাখ সদস্য অপরাধ কর্মকা-ে জড়িত। অনেকেই আবার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়ে  দেশের সুনাম নষ্ট করছে। তারা সহজেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছে। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের একটি চক্র মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আদম পাচার করছে। শতাধিক সদস্যের ওই পাচার চক্র এতই শক্তিশালী যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মধ্যে টেকনাফ নয়াপাড়া ক্যা¤েপ সরকারি তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। এই ক্যা¤েপর আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আরও প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। উখিয়া ও টেকনাফের দুটি ক্যা¤েপ ৩২ হাজার রোহিঙ্গা তালিকাভুক্ত হলেও ক্যা¤েপর ভেতরে এবং সংলগ্ন এলাকায় আরও প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা তালিকা ছাড়াই অবস্থান করছে অবৈধভাবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
টেকনাফের বাসিন্দা মো. হোসাইন জানান, প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। এরা কে কোথায় যাচ্ছে কারও কোন হিসাব নেই! এদের কি করা হবে তার কোন সঠিক উত্তর নেই। যে হারে রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ছে এক সময় আমাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। তখন আমরা কই যাব! মিয়ানমার সরকারকে আন্তজার্তিকভাবে চাপ দেওয়া দরকার এইটা কোন সমাধান নেই। যেসব রোহিঙ্গা আগে থেকে আছে তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত দিতে পারেনি। নতুন করে যারা ঢুকছে তাদের কিভাবে ফিরিয়ে দিবেন? তাছাড়া কোন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোন নিয়ন-কানুন নেই। যার যেমন ইচ্ছে তারা সেইটা করে যাচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
রোববার সকালে টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মো. রশিদ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, মিয়ানমারে সৈন্যরা এখনো রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, স¤পদ লুট করে, নারীদের ধর্ষণ করে এবং নির্বিচারে হত্যাকা- চালায়। ওপারে সহিংসতার পর থেকে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে প্রতিদিন ঢুকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। আমার বাড়ি ছোট গজরবিল। আমার পরিবারের আট সদস্য ছিল। কিন্তু কে কোথায় সেইটা আমি জানিনা। তারা কি মরে গেছেÑনাকি বেঁচে আছে, সেটাও আমি বলতে পারিনা।
তিনি আরো বলেন, সৈন্যরা প্রথমে আমার বাড়িতে ঢুকে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে। এসময় আরো ৫ জন নারীকে ধরে নিয়ে যায়। তারা এখনো নিখোঁজ রয়েছে। ওরা এত নিষ্ঠুর সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। আমাদের গ্রামের সব বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। শত শত নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে এবং অনেক পুরুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তার পরিমান আমার অজনা।
গতকাল দালালের মাধ্যমে নারীসহ ১৫ জন মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এছাড়া উপজেলার কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা ঢুকছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলী জানান, যে হারে রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে এতে আমরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছি। কেননা রোহিঙ্গা আগে থেকে আমাদের দেশে বোঝা হয়ে আছে। এর মধ্যে আবার নতুন করে রোহিঙ্গা ঢুকছে। তাছাড়া রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপরাধামূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। এতে আমরা খুবই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি।
টেকনাফ নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পুলিশের কর্মকর্তা আবুল কাশেম জানান, ক্যাস্পে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। রোহিঙ্গারা কে কোথায় যাচ্ছে খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে। নতুন করে কোন রোহিঙ্গা যাতে ঢুকতে না পারে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। দৈনিক কক্সবাজার রিপোর্ট :

পাঠকের মতামত: