বশির আল মামুন, চট্রগ্রাম অফিস :::
চট্টগ্রাম বাসীর বহুল প্রতীক্ষিত কর্ণফুলী টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর আশার আলো দেখছেন চট্টগ্রামবাসী। পাশাপাশি বাঁশখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজের উদ্বোধনের ফলে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের কাজও আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে। এই তিন প্রকল্পের অর্থমূল্য অন্তত ৪৫ হাজার কোটি টাকা; যেগুলোর প্রত্যেকটিতে চীন নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ-চীন সর্ম্পকের নতুন যুগে চট্টগ্রাম বদলে যাবে।
বাংলাদেশ ও চীন শুক্রবার যেসব মেগা প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন ও চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তার মধ্যে এই তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে চট্টগ্রামে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম শহরসহ আশপাশের অঞ্চলের চেহারা আমূল পরিবর্তন ঘটবে। এই অঞ্চলে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। চট্টগ্রাম নগরী আধুনিক নগরে পরিণত হবে। গতিশীল হবে দেশের অর্থনীতি। এ ছাড়া কর্ণফুলী নদী শাসন সহ নানা মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সুফল মিলবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বিডি সংবাদ কে বলেন, ‘চট্টগ্রামকে ঘিরে যে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তা এগিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে কর্ণফুলী টানেল। যোগাযোগ ও অবকাঠামো ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিল্প ও পাওয়ার সেক্টরে নতুন নতুন বিনিয়োগ হবে। বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রফতানির বাণিজ্য বাড়বে। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হবে এই অঞ্চল।’
প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জিটুজি ভিত্তিতে নদীর তলদেশে কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হবে। চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) টানেলের নির্মাণ কাজ করবে। আর চীন সরকার এই প্রকল্পে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে। বাকি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার।
সড়ক ও সেতু বিভাগের এক সূত্র জানায়, নদীর তলদেশে টানেলের দৈর্ঘ্য হবে তিন কিলোমিটারের বেশি। কর্ণফুলী নদীর ভাটির দিকে নেভাল একাডেমির কাছে হবে টানেলের প্রবেশপথ। টানেলের বহির্গমন পথ হবে আনোয়ারায় কাফকো সার কারখানার পাশে। টানেল নির্মাণে নদীর তলদেশে প্রায় একশ ফুট গভীরে বসানো হবে ৩৫ ফুট প্রশস্ত দুটি টিউব যা নদীর বর্তমান তলদেশ থেকে অন্তত ৯০ ফুট গভীরে থাকবে। দুটি টিউবে গাড়ি চলাচলের জন্য দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। দুটি টিউবের মাঝামাঝি ৩৬ ফুট দূরত্ব থাকবে।
সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর আগে চলতি মাসেই টানেল নির্মাণের কাজ শুরুর কথা বললেও ইতোমধ্যে তিনি পুনরায় জানিয়েছেন, চুক্তি স্বাক্ষর হলেও অর্থায়ন প্রক্রিয়া ও আনুষঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে আরো কিছু সময় লাগবে। তাই আগামী ডিসেম্বরেই টানেলের মূল কাজ শুরু হবে। আর ২০২০ সালে টানেলটি ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে নির্বাচনী জনসভায় প্রথম কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ করে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘এক নগর-দুই শহর’ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে টানেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর কর্ণফুলীর মোহনায় একমত হলে পরবর্তী ধাপের কার্যক্রম শুরু হয়।
সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্রের ভাষ্য, টানেল নির্মিত হলে চট্টগ্রাম নগরীকে চীনের বাণিজ্যিক নগরী সাংহাইয়ের আদলে গড়ে তোলা যাবে। টানেলটি কর্ণফুলী নদীর দুই তীর তথা চট্টগ্রামের মূল শহর ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করবে। এর ফলে চট্টগ্রামে যানজট যেমন কমবে, তেমনি কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগের সময় কমবে। আর নদীর দু’প্রান্তে শিল্পায়ন বাড়ার পাশাপাশি নগরও সম্প্রসারিত হবে। এছাড়া এই টানেল বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) অর্থনৈতিক করিডোরে যুক্ত হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের পর নদীর অপর পাড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। নগর যোগাযোগে গতি আসবে। পাশাপাশি মিরসরাই থেকে উপকূল ঘেঁষে কক্সবাজার পযন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে এই এলাকায় দ্রত অর্থনৈতিক প্রসার ঘটবে।
এদিকে দেশের চলমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গতি সৃষ্টি করবে আনোয়ারা উপজেলায় নির্মিতব্য চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল। গত শুক্রবার চীনের সাথে এই প্রকল্পের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। জিটুজি পদ্ধতিতে আনোয়ারায় ৭৭৪ একর জমিতে প্র্রস্তাবিত এই প্রকল্পে ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। এতে ৩৭১ শিল্প-কারখানায় ৫৩ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জানিয়েছেন, এই প্রকল্পে আরো কিছু আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি বাকি রয়েছে, যা দ্রুত সময়ে শেষ করার জন্য কাজ চলছে। সবকিছু ঠিকমতো এগুলো ২০১৭ সালের প্রথম ভাগে কাজ শুরু করে ২০২০ সালের মধ্যে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা আছে। এতে তৈরি পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যালস, টেলিযোগাযোগ, কৃষিনির্ভর শিল্পকারখানা, রাসায়নিক দ্রব্য, যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রোনিকস, টেলিভিশন, মনিটর, চিকিত্সা সরঞ্জাম, প্লাস্টিক, আইটি খাতের কারখানা গড়ে উঠবে। ওই প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের ৩০ শতাংশ আর চীনা বিনিয়োগকারীদের ৭০ শতাংশ অংশীদারিত্ব থাকবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের সাথে সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এই অঞ্চলে উন্নত অবকাঠামো ও যোগাযোগ নিশ্চিত করা গেলে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ হবে। পাশাপাশি এই অঞ্চলে বেসরকারিভাবেও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যস্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করে বিসিআইএম করিডোরকে সক্রিয় করতে পারলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ। পাশাপাশি দোহাজারি থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ করে ওই রেল লাইন মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলে সংশ্লিষ্ট সকল দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।
পাঠকের মতামত: