চাঁদা না দিলে ব্যবসায়ীদের মালামাল সৈকতে ফেলে নষ্ট করে বিচকর্মীরা
কক্সবাজার প্রতিনিধি ::
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ও সুগন্ধা সড়কের দুপাশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। এমনকি অসহায় বাদাম-ঝালমুড়ি, ডিম বিক্রেতাও এর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
দীর্ঘদিন ধরে অনেকটা প্রকাশ্যে ও জোরপূর্বক এ চাঁদার টাকা আদায় করছেন বিচকর্মীরা। কলাতলী, সুগন্ধা, লাবণী ও ইনানীর শতাধিক হকার ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেনের নির্দেশে এই চাঁদার টাকা আদায় করছেন বিচকর্মীরা। কর্মীদের অনেকে বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ম্যাজিস্ট্রেট ইয়ামিন হোসেন। তবে এ বিষয়ে স্থানীয় একটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি।
হকার ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসার প্রকারভেদে সৈকতের হকার ও সড়কের পাশের ভ্রাম্যমাণ ৪০০ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ‘জেলা প্রশাসনের নামে’ দৈনিক ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। এভাবে দৈনিক এক থেকে দেড় লাখ টাকা এবং বছরে অন্তত ৪ কোটি টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়।
যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে মিলেছে অভিযোগের সত্যতা। অনুসন্ধান চলাকালে বিষয়টি কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরানের নজরে আনা হলে অনেকটা তড়িঘড়ি করে বৃহস্পতিবার ম্যাজিস্ট্রেট ইয়ামিন হোসেনকে (এডিএম) সরিয়ে সার্বিক ও পর্যটন সেলের ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ রানাকে স্থানীয় সরকারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কলাতলী, সুগন্ধা, লাবণী ও ইনানী সমুদ্রসৈকতে ৪শর বেশি হকার রয়েছে। তারা প্রতিদিন সৈকতে হেঁটে হেঁটে পর্যটকদের কাছে বাদাম, ঝালমুড়ি, চিপস, চা, কফি, পানি, জুস, ডিম, ঝিনুক, আচার, পান ও সিগারেট বিক্রি করেন। এসব হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা নেন জেলা প্রশাসনের নিয়োজিত বিচকর্মীরা।
কোনো হকার টাকা দিতে না পারলে সৈকতে ফেলে দেওয়া হয় মালামাল। আবার কখনো কখনো মালামাল জব্দ করে হকারদের আটক করে রাখা হয় জেলা প্রশাসনের বক্সে। এরপর টাকা আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়া সুগন্ধা সড়কের একপাশে অবৈধভাবে বসানো হয়েছে ২ শতাধিক ভ্রাম্যমাণ দোকান।
এসব দোকানে রয়েছে ফিশ ফ্রাই, বিরিয়ানি, চা, ডিম, ঝিনুক, শুঁটকি, কাপড়, চশমা, আচারসহ বিভিন্ন পণ্য। আরেক পাশে অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয়েছে মেহেদি মার্কেট। সেখানেও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ৬২টি দোকান। এসব অস্থায়ী মার্কেট ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দৈনিক ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে বিচকর্মীরা।
চাঁদার রেট বাড়ানোর জন্য মাসে কয়েকবার ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে চালানো হয় অভিযান। অভিযান শেষ হলে ম্যাজিস্ট্রেটকে ম্যানেজের নামে চাঁদার রেট বাড়িয়ে দেন বিচকর্মীরা। বাদাম-ঝালমুড়ি, ডিম বিক্রেতাদের অভিযোগ, যেখানে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা বিক্রি করে সংসার চালানো দায় হয়ে যায়, সেখানে বিচকর্মীরা ম্যাজিস্ট্রেটের কথা বলে দৈনিক চাঁদা দিতে বাধ্য করেন। চাঁদা না দিলে সবকিছু কেড়ে নিয়ে সৈকতের বালিতে ফেলে নষ্ট করেন।
শুধু তাই নয়, কেউ যদি নতুন দোকান বসাতে চায় গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। সম্প্রতি কয়েকটি নতুন ফিশ ফ্রাই ও অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ দোকান বসাতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) ইয়ামিন হোসেনের অফিসের এসি ও আসবাবপত্রের জন্য কয়েক লাখ টাকা চাঁদাও তোলেন বিচকর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বিচকর্মীদের চাঁদাবাজির বিষয়টি তাদের একান্ত মনে করে কয়েকজন ব্যবসায়ী অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট ইয়ামিন হোসেনকে অভিযোগ দিলে উল্টো বিচকর্মীদের কথামতো না চললে দোকান বন্ধের হুমকি দেন তিনি।
সম্প্রতি দুই বিচকর্মীর বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে ক্যামেরা জব্দ করে রেজিস্টার বইতে লিপিবদ্ধ না করা এবং মাদকদ্রব্য ক্রয় ও সেবনের অভিযোগে লিখিত কারণ দর্শানোর জন্য দুটি নোটিশ দিয়েছিলেন কক্সবাজার পর্যটন সেলের সহকারী কমিশনার মাসুদ রানা। তিন কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে কারণ দর্শাতে বলা হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে প্রমোশন।
সমুদ্রসৈকতের একাধিক হকার ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী বলেন, বিচকর্মীদের প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয়। টাকা না দিলে ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অভিযান চালানো হয়। চলে উচ্ছেদের পাঁয়তারা। শফিউল, তহিদুল, রিপন, জাহেদ ও বেলালসহ বেশ কয়েকজন বিচকর্মী চাঁদা আদায় করে।
সুগন্ধার কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীর বড় সুবিধাভোগী হলো জেলা প্রশাসন। তারাই চাঁদার বিনিময়ে সমুদ্রসৈকত ও রাস্তার দুপাশে টিকিয়ে রেখেছে। তাই এটা তারা সহজে বন্ধ করবে না। ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী ও হকার থাকলে চাঁদাবাজিও থাকবে, তাদের পকেটও ভরবে।
চাঁদা তোলার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন বিচকর্মী একইরকম তথ্য দিয়ে বলেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইয়ামিন হোসেন স্যার যোগদান করার কিছুদিন পর থেকে তাদের মোটা অঙ্কের চাঁদা তুলতে বাধ্য করেন। আগেও আমরা চাঁদা তুলতাম কিন্তু সেটা নিজেদের খরচের জন্য সামান্য। এখন টার্গেট করে দৈনিক এক থেকে দেড় লাখ চাঁদা তুলতে হচ্ছে।
কক্সবাজার বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অধীনে শতাধিক বিচকর্মী রয়েছে। বিচকর্মীদের ইনচার্জ মো. হোসেন জানান, তাদের ৩৮ জনের কাজ হচ্ছে পর্যটকদের সেবাসহ নিরাপত্তার দেখভাল করা। বাকিদের কাজ বিচ পরিষ্কার করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, চাঁদা আদায়েই বেশি ব্যস্ত থাকে তারা।
বিচকর্মীদের চাঁদাবাজির বিষয়ে স্থানীয় একটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে প্রতিবেদক ও সম্পাদককে ডেকে নিয়ে পত্রিকার ডিক্লারেশন বন্ধের হুমকি দেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইয়ামিন হোসেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় অনিয়মের বিষয় তুলে ধরায় দৈনিক সমুদ্রকণ্ঠ নামে একটি স্থানীয় পত্রিকাকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর্যবেক্ষণ কার্ড দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইয়ামিন হোসেন সব অভিযোগ অস্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, আমি কোনো চাঁদাবাজির সঙ্গে নেই, সব অভিযোগ মিথ্যা। পত্রিকা বন্ধের হুমকির বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন। এ সময় তিনি বৃহস্পতিবার থেকে (এডিএম) এর দায়িত্বে নেই জানিয়ে এসব বিষয়ে আর কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, কেউ কখনো আমার কাছে এসব বিষয়ে অভিযোগ করেনি। তবে কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) ও পর্যটন সেলের দুজনের দায়িত্ব পরিবর্তন করে নতুন দুজনকে সংশ্লিষ্ট শাখায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানান। দৈনিক যুগান্তর
পাঠকের মতামত: