ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

অল্পবয়সী তরুণীদের ধরে এনে ওসি প্রদীপের হাতে তুলে দেয়া হতো

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ::
সেনাবাহিনীর মেজর (অব) সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের তাবেদার খ্যাত একাধিক পুলিশ সদস্য, চৌকিদার-দফাদার ও কিছু চিহ্নিত মাদক কারবারিকে আইনের আওতায় আনার দাবি উঠেছে। টেকনাফে মাদকের মিথ্যা অভিযোগে অল্পবয়সী সুন্দরী তরুণীদের ধরে এনে ওসি প্রদীপের হাতে তুলে দিত ওই দালালরা। সূত্র জানায়, টেকনাফের বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ছাড়াও র্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্তেও উঠে এসেছে ওসি প্রদীপের ধর্ষণ-সম্পৃক্ততার এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। র্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ খায়রুল ইসলাম মেজর সিনহা হত্যা মামলার তদন্তে গেলে একাধিক নারী পুরুষ ওইসময় তাকে এ অভিযোগ করেন।

অভিযোগ রয়েছে, থানা ও থানার বাইরে নির্ধারিত রুমে অসহায় ওই তরুণীদের নিয়মিত ধর্ষণ করত ওসি প্রদীপ। স্থানীয়দের দাবি, প্রদীপের সহযোগী হোয়াইক্যং ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মশিউর ও তাদের চিহ্নিত দালালরা অর্ধশতাধিক নারীকে ইয়াবা কারবারি আখ্যা দিয়ে তাদের বাড়ি থেকে ধরে এনে প্রদীপের কাছে তুলে দিয়েছে। ওসি প্রদীপ ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে এসব অসহায় নারীকে। ওই সময় প্রদীপের ভয়ে নির্যাতিতা কেউ মামলা না করায় ধামাচাপা পড়ে প্রদীপের বিরুদ্ধে সিরিয়াল ধর্ষণের অভিযোগগুলো।

সূত্র আরও জানায়, টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপের দাপটে অনৈতিক বেশি সুবিধা আদায় করেছে এসআই মশিউর, চৌকিদার-দফাদার ও কয়েকজন মাদক কারবারি। হোয়াইক্যং ও বৃহত্তর হ্নীলা এলাকায় ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে প্রদীপের সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা করেছে হোয়াইক্যং ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ দারোগা মশিউর। এছাড়াও মাদক কারবারিদের বশে এনে মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা লাখ লাখ পিস ইয়াবার চালান থেকেও বখরা নিয়েছেন এসআই মশিউর। কাটাখালীতে ৫ লাখ পিস ইয়াবা লুটের ঘটনায় মাত্র ২০ হাজার পিস জব্দ দেখিয়ে কয়েক ইয়াবা লুণ্ঠনকারী ও এসআই মশিউরের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ধরনের ইয়াবা লুটের একাধিক ঘটনায় সালিশের নামে ভাগ বসিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাও। এ বিষয়ে এসআই মশিউরের মুঠোফোনে একাধিকবার কল এবং এসএমএস দেয়ার পরও তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

অভিযোগ থেকে জানা যায়, হোয়াইক্যং এলাকার আনোয়ার নামে এক ব্যক্তিকে আটকে রেখে ওসি প্রদীপ ও এসআই মশিউর অর্ধ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা দিতে অক্ষম ওই ব্যক্তিকে তিন দিন পর বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে- প্রদীপ ও মশিউরের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইতে আদালতে যায় নিহত ব্যক্তির মেয়ে এবং বোন। খবর পেয়ে কক্সবাজার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ওই দুই নারীকে তুলে নিয়ে আসে মশিউরের নেতৃত্বে ওসি প্রদীপের লোকজন। থানায় আটকে রেখে গণধর্ষণের পর ইয়াবা দিয়ে অসহায় ওই দুই নারীকে কোর্টে চালান দেয়া হয়।

অভিযোগ করে টেকনাফের নাজিরপাড়ার এক গৃহবধূ জানান, মাদক কারবারি বলে তার স্বামীকে ধরে থানায় নিয়ে ৪৫ লাখ টাকা দাবি করে ওসি প্রদীপ। স্বামীকে ছাড়িয়ে আনতে স্বর্ণালঙ্কার ছাড়াও নগদ ৩ লাখ টাকা নিয়ে থানায় গেলে ওসি প্রদীপের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে ওই গৃহবধূর প্রতি। স্বামীকে মুক্ত করে দেয়ার আশ্বাসে তিন দিন আটকে রেখে ওসি প্রদীপসহ কয়েকজন মিলে তাকে ধর্ষণ করে। এরপর তাকে বলা হয় তোমার স্বামী ছাড়া পাবে, তুমি ঘরে চলে যাও। কিন্তু পরদিন তার স্বামীর গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন ওই মহিলা। ওই সময় ধর্ষণের বিষয়ে মুখ খুললে পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দেয় ওসি প্রদীপ। ওসি প্রদীপ এবং তার ব্যক্তিগত বাহিনীর হাতে ধর্ষণের শিকার হওয়া হৃীলার অপর এক গৃহবধূ জানান, ইয়াবা কারবারি আখ্যা দিয়ে অহেতুক তার স্বামীর কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে সন্ত্রাসী গিয়াস ও এসআই মশিউর। চাঁদা না দেয়ায় সন্ধ্যায় এসআই মশিউর বাড়িতে এসে ওই মহিলাকে ইয়াবা কারবারি বলে হোয়াইক্যং ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। অজ্ঞাত স্থানে তিন দিন আটকে রেখে ওসি প্রদীপ, মশিউর ও সন্ত্রাসীরা তাকে গণধর্ষণ করে। এরপর ইয়াবা দিয়ে আদালতে চালান করে দেয়া হয়।

উখিয়ার কোর্ট বাজারের এক মেয়ের অভিভাবক জানান, ধর্ষকদের কবল থেকে উদ্ধার করে আমার তরুণী মেয়েকে প্রদীপ নিজেও ধর্ষণ শেষে ইয়াবা দিয়ে চালান করে দেয়। মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয় ধর্ষকদের। ২০১৯ সালের শেষের দিকে কলেজপড়ুয়া ১৭ বছরের ওই তরুণী টেকনাফে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে প্রেমিকসহ কয়েকজন মিলে তাকে ধর্ষণ করে। ঘটনাক্রমে বিষয়টি ওসি প্রদীপ জানলে এমন ঘৃণ্যতম কা- ঘটান তিনি। প্রদীপ ও তার বাহিনীর লোকজনের ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের অবস্থা জটিল হলে ধর্ষিতাদের পাঠানো হতো কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দেয়া হয়েছে তাদের চিকিৎসা। এর বাইরেও অনেকে গর্ভবতী না হওয়ার জন্য চিকিৎসা নিলেও লজ্জায় ধর্ষণের কথা স্বীকার করেনি কাউকে। তাই প্রদীপকা-ে সহযোগিতাকারীদের কারণে নির্যাতিত মহিলাদের পক্ষে মামলা রুজু করে ওই লম্পটদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।

পাঠকের মতামত: