এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া :: ঘরের ভেতরে এইপ্রথম বায়োফ্লক পদ্ধতির মাছচাষের সুচনা করে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ইলিশিয়া এলাকার বাসিন্দা সফল মৎস্যচাষী গিয়াসউদ্দিন রীতিমত বাজিমাত করেছেন। আধুনিক যুগে জমির স্বল্পতার এই দুর্দিনে কমখরচে ঘরের ভেতরে মাছচাষ করে ইতোমধ্যে অধিক লাভের হদিস পেয়েছেন যুবক গিয়াস উদ্দিন। তাঁর উদ্ভাবনী এ মৎস্যচাষ নিজ এলাকা পেরিয়ে এখন পুরো কক্সবাজার জেলায় মৎস্য চাষের সাথে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে মডেল হিসেবে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি যুবক গিয়াস উদ্দিনের এই প্রয়াস এতদাঞ্চলের বেকার যুবকদের সামনে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন অনেকে।
চকরিয়া উপজেলার পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়নের ইলিশিয়া গ্রামের যুবক গিয়াস উদ্দিন ২০১২ সাল থেকে মাছ চাষ করছেন। ইলিশিয়া এলাকার জমিদার বাড়ি ও আশপাশের ব্যক্তিগত পুকুর ইজারা নিয়ে তিনি সাদা জাতের মাছ চাষের শুরু করেন। উচ্চ শিক্ষিত যুবক গিয়াসউদ্দিন সরকারি বা বেসরকারি চাকুরীতে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি অবিচল ছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
চাকুরীর নামে সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পরপর পুকুর ইজারা নিয়ে ২০১২ সালে শুরু করেন মাছচাষ। গেল আটবছরে গিয়াস উদ্দিন মাছচাষের মাধ্যমে বদলে নিয়েছেন জীবনের চাকা। ব্যবসার পরিধি বেড়েছে বছর বছর। পেয়েছেন অধিক মুনাফাও। এভাবে এগিয়ে গেছেন যুবক গিয়াস উদ্দিন। তিনি এখন আর্থিকভাবে বেশ স্বাবলম্বি। মাছচাষের বদৌলতে যেমন তাঁর জীবনের গতি ফিরেছে, সেইসঙ্গে এগিয়ে নিয়েছেন লেখাপড়াও। ব্যবসায়ীক সুনাম আর খ্যাতির পাশাপশি অধম্য গিয়াস উদ্দিন ইতোমধ্যে নিয়েছেন উচ্চতর ডিগ্রিও।
সফল মাছচাষী গিয়াস উদ্দিন বলেন, যখন এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, চাকুরী করবো না। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। সেই প্রতিজ্ঞা থেকে আটবছর আগে ২০১২ সালে বাড়ির পাশে ইলিশিয়া এলাকায় ব্যক্তিগত ৭-৮টি পুকুর ইজারা নিয়ে শুরু করি সাদাজাতের মাছচাষ। কায়িম প্ররিশ্রম আর সততাগুনে আমি আজ সফলও হয়েছি। আটবছর যাবত নিজেকে মাছচাষের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছি।
তিনি বলেন, মাছচাষ আমার জীবনের গতি বদলে দিয়েছে। আজ আমি আর্থিকভাবে বেশ স্বাবলম্বি। আমার পরিবারও তাতে ভীষন খুশি। এলাকাবাসিও আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। আমি নিজের জীবনের সফলতাকে বেকার জনগোষ্ঠি বিশেষ করে যুবকদের কল্যাণে নিহিত করতে সিদ্বান্ত নিই। সবাইকে আমার মতো জীবন বদলের গল্পে সম্পৃক্ত করতে সর্বশেষ উদ্যোগটি নিই বায়োফ্লক পদ্ধতির মাছ চাষ সুচনার মাধ্যমে।
গিয়াস উদ্দিন বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে একদিন ইউটিউব গাটঁতে গাটঁতে বায়োফ্লক পদ্ধতির মাছ চাষের একটি কেস্ স্ট্যাডি পাই। সেটি অনুসরণ করে দেখি কীভাবে কমখরচে ঘরের ভেতরে মাছচাষ করা হচ্ছে। বাস্তবে এই পদ্ধতির মাছচাষ দেখতে আমি একাধিকবার কুমিল্লা গিয়েছি। সেখানে বেশ ক’জন চাষী বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অনেক আগে মাছচাষ শুরু করেছেন।
গিয়াস উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, আমি চেষ্ঠা করেছিলাম কুমিল্লা গিয়ে মাছচাষের পদ্ধতি দেখে আসবো। তারপর এলাকায় সেটি শুরু করবো। ওইসময় অনেকে আমাকে পদ্ধতিটি দেখাতেও অনীহা দেখিয়েছিলেন। তবু আমার প্রচেষ্ঠা আজ আমাকে সেই কাজে মনোনিবেশ করেছে। অবশেষে চলতিবছরের ফেব্রয়ারী মাস থেকে আমি ১৩ ফুট প্রস্ত ও ১৩ ফুট দৈর্ঘ্য আয়তনের একটি ঘরে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছচাষ শুরু করলাম।
চাষের উপর্সগ প্রসঙ্গে বলেন, এ চাষে প্রয়োজন অল্প পরিমাণের একটি জায়গা, সেখানে থাকবে একটি ট্যাগ (গোল আকারের খাঁচা) এবং পর্যাপ্ত বিদ্যুত ব্যবস্থা। বিদ্যুত চলে গেলে আইপিএস অবশ্যই থাকতে হবে। মুলত বিদ্যুতের পাম্পের সাহায্যে খাঁচার পানিতে বাতাস (অক্সিজেন) দিতে হয়। তাতে বুদ বুদ আকার সৃষ্টি করলে মাছ খাদ্যের প্রতি আগ্রহী হয়।
সফল মাছচাষী গিয়াস উদ্দিন বলেন, প্রথমে আমি তেলাপিয়া মাছের চাষ করেছিলাম। মাছের পোনা ও বিদ্যুত বিল বাবত আমার খরচ পড়ে ১৪ হাজার টাকা। চারমাসে মাছ বিক্রি করে আয় করি ৩৪ হাজার টাকা। পরবর্তীতে গেল জুলাই মাসে শুরু করি দেশীয় জাতের শিং মাছের চাষ। জুলাই মাসের ২৭ তারিখ ১৪শত লাইন সাইজের ৮ হাজার পোনা ছেঁেড়ছি। ১ মাস ১৪ দিনে মাছের বর্তমান সাইজ দুইশত লাইনে উত্তীণ হয়েছে। প্রতিদিন ১০ কেজি করে খাদ্য দিতে হচ্ছে আট হাজার মাছকে।
গিয়াস উদ্দিনের মতে, আগামী পাঁচমাস পর বায়োফ্লক পদ্ধতির চাষের শিং মাছ বিক্রি করতে পারবো। ওইসময় ৮ থেকে ১০টিতে হবে এককেজি মাছ। উল্লেখিত সময়ে মাছচাষে অর্থাৎ মাছের খাদ্য ও বিদ্যুত বিল বাবত আমার খরচ পড়বে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর বিক্রি করে আমার ভাগে আসবে ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা।
ইতোমধ্যে সফল মাছচাষী গিয়াস উদ্দিনের বায়োফ্লক পদ্ধতির মাছচাষ কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো.বেনজির আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে এই পদ্ধতির মাছচাষ শুরু হয়েছে অনেকদিন আগে। তবে চকরিয়া উপজেলায় এই প্রথম যুবক গিয়াস উদ্দিন এই পদ্ধতির মাছচাষ শুরু করেছেন। নিসন্দেহে এটি এলাকাবাসির জন্য সুখবর। বিশেষ করে এতদাঞ্চলের বেকার জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গিয়াস উদ্দিনের এই উদ্যোগটি মডেল হতে পারে।
তিনি বলেন, জমি স্বল্পতার এই দুর্দিনে যুগ এতটাই পাল্টে গেছে যে মাছ চাষ করার জন্য এখন আর পুকুর বা ডোবার দরকার পরে না। নির্দিষ্ট কলাকৌশল আর প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে ঘরের ভিতর চৌবাচ্চাতে চাষ করা যাচ্ছে মাছ। মুলত বায়োফ্লক টেকনোলজি ব্যবহার করে অল্প জমিতে অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব। এতে অধিক মুনাফাও পাচ্ছেন চাষীরা।#
পাঠকের মতামত: