২০১৭ সালের আগস্টে এভাবেই দল বেঁধে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে বাংলাদেশে। —ফাইল ছবি
নিউজ ডেস্ক ::
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শিবির থেকে রোহিঙ্গারা সপরিবারে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গার মধ্যে অনেকেই মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্য নিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ছে। অনেক রোহিঙ্গা উন্নত জীবনযাপনের আশায় দেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে। আবার অনেকে শিবিরের বাইরে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজনের ডাকে সাড়া দিয়ে রোহিঙ্গা শিবির ছাড়ছে। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী শিবিরগুলো থেকে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার খোঁজ মিলছে না। এক বছরের মধ্যে শিবিরের এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা পালিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় জনজীবনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে ভারত থেকে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গার সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। প্রায় প্রতিদিনই ভারত থেকে সীমান্ত গলিয়ে রোহিঙ্গার দল ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। এসব রোহিঙ্গার গন্তব্য হচ্ছে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির। এরই মধ্যে এক হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা ভারত থেকে কক্সবাজারে ট্রানজিট ক্যাম্পে এসে পৌঁছেছে। এদিকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ায় শিবিরের তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি এনজিওকর্মীরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এ কারণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ভেরিফিকেশন (যাচাই) শুরু হয়েছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত ৩৭ হাজার পরিবারের রোহিঙ্গাদের যাচাই কাজ শেষ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনসহ রোহিঙ্গা শিবির তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বেশ কিছু রোহিঙ্গার খোঁজ মিলছে না। এ রকম নিখোঁজ রোহিঙ্গার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র এক লাখ ৬০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা পরিবার বর্তমানে রেশন নিচ্ছে বলে জেনেছি।’
রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) সূত্রে জানা গেছে, শিবিরগুলোতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির আওতায় আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা রয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজার। অথচ বর্তমানে শিবিরে রোহিঙ্গার হদিস মিলছে ৯ লাখ ১৫ হাজার। আরো দুই লাখ রোহিঙ্গার হদিস না মেলায় সর্বত্র উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে রেশন বিতরণের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কর্মীরা জানিয়েছেন, দিনে দিনে রেশনগ্রহীতা রোহিঙ্গা পরিবারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) তরফে চারটি এনজিও যথাক্রমে রিক, মুক্তি, এসিএফ ও ইপসা রোহিঙ্গাদের মাঝে চাল, তেল ও ডাল বিতরণ করে থাকে। এসব এনজিওর কর্মীরা জানিয়েছেন, শিবিরের দুই লক্ষাধিক পরিবারের মধ্যে বর্তমানে রেশন নিচ্ছে মাত্র এক লাখ ৬০ হাজারের মতো পরিবার। অবশ্য আরো বেশ কয়েকটি এনজিও রোহিঙ্গাদের মাঝে অন্যান্য সামগ্রী বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে।
জানা গেছে, নানা কারণে রোহিঙ্গারা দলে দলে শিবির ছেড়েছে। এমন কিছু রোহিঙ্গা আছে যারা শহর বন্দরে গার্মেন্ট বা বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করে স্থায়ী বসবাসের আশা নিয়ে শিবির ছাড়ছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিবির পালানোর প্রবণতা ঠেকাতে নানাভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো উদ্যোগ নিলেও কোনোভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।
এমনকি এ মাসে কাঁচা মাছ সরবরাহে ব্যবহৃত ড্রামের ভেতরে অবস্থান নিয়ে সড়ক পথে পালানোর সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশের আলাদা অভিযানে ১০ জন রোহিঙ্গা আটক হয়েছে। এসব রোহিঙ্গাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
রোহিঙ্গা শিবিরভিত্তিক একশ্রেণির রোহিঙ্গা দালালের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর জন্য রোহিঙ্গাদের উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগ উঠেছে। গত মাসের প্রথম সাপ্তাহে বিজিবি সদস্যরা টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ চরাঞ্চল থেকে ১১ রোহিঙ্গাকে আটক করে উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে হস্তান্তর করেছে। এসব রোহিঙ্গার দেওয়া তথ্যে উঠে এসেছে তারা দালালের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে শিবির ত্যাগ করেছিল। কুতুপালং শিবিরের ১২ নম্বর ব্লকে কর্মরত এনজিও সংস্থা ইপসার এক কর্মকর্তা রবিবার সকালে উখিয়া থানার ওসিকে জানিয়েছেন, বেশ কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে যেকোনো সময়ে শিবির ত্যাগ করতে পারে। এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিতে তিনি পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন।
কুতুপালং রেজিস্টার্ড শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা রশিদ আহমদ রোহিঙ্গাদের শিবির থেকে পালানোর বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, কিছু কিছু রোহিঙ্গা আছে যারা এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি।
রোহিঙ্গা নেতা বলেন, কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা শহরের গার্মেন্ট অথবা বিভিন্ন কাজের অজুহাতে ক্যাম্প ছাড়ছে। অনেকেই বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনের আহ্বানে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কুতুপালং শিবিরের ইনচার্জ রেজাউল করিম জানান, রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গাদের শিবির পালানোর কোনো সুযোগ নেই।
উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের জানান, সড়কপথে চারটি পুলিশ চেকপোস্ট দিয়ে বিশাল রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তার পরও যেসব রোহিঙ্গা পালাতে গিয়ে ধরা পড়ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধূরী জানান, বর্তমান সরকারের দক্ষতায় যদি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয় তাহলে শিবির পালানো রোহিঙ্গাদের খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে।
পাঠকের মতামত: