ঢাকা,সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

রোহিঙ্গার কারনে স্থানীয় নারীরা কেন বৈষম্যতার শিকার হচ্ছে?

নিউজ ডেস্ক ::
কক্সবাজারের বালুখালী থেকে গত শনিবার উখিয়া বাজারে যাওয়ার একটি অটোরিকশায় পেছনের আসনে ছিলেন বোরকায় চোখ-মুখ ঢাকা দুই নারী। পথে নিরাপত্তা তল্লাশি চৌকিতে পরিচয়পত্র দেখিয়েছিলেন তাঁরাও। পরিচয়পত্র পরীক্ষার সময় তাঁদের মুখের কাপড় সরাতে বলা হয়। জয়নাব নামে স্থানীয় এক নারী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য এখন তাঁদের নিজ বাড়িঘরের সামনেই তল্লাশির শিকার হতে হয়। বোরকা সরিয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে হয়।

উখিয়ার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গাদের উপস্থিতির কারণে স্থানীয় নারীদের অনেক সমস্যা হচ্ছে। দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় ওই এলাকার নারীরা ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল, পর্দানশিন। এখন লোকালয়ের আশপাশে অনেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ায় স্থানীয় নারীরা আর তাদের রক্ষণশীল ও পর্দানশিন জীবনযাত্রা অনুসরণ করতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বিদেশের এবং দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন এখন সেখানে আসছে।

রফিকুল বলেন, ‘এখানে মেয়েরা আগে এভাবে অবাধে চলাফেরা করত না। এখন অনেক মেয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে, এনজিওতে চাকরি করছে। আমাদের যে পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন ছিল সেটি এখন নষ্ট হওয়ার পথে। এসব নিয়ে অভিভাবক ও বয়োজ্যেষ্ঠরা উদ্বিগ্ন।’

রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি বিদেশি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত নীলিমা নওরীন গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে কক্সবাজারে আশ্রয়শিবির থেকে কালের কণ্ঠকে জানান, রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশের এলাকার লোকজন বেশ রক্ষণশীল। স্থানীয় নারীদের অনেকে রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করছে। এটি ইতিবাচক দিক। আবার তাদের এই কাজ করা, পোশাক, বাড়ি ফেরার সময়—এসব নিয়ে পরিবার ও স্থানীয়দের অনেকে উদ্বিগ্ন। কাজ থেকে ফেরার সময় উৎসাহী লোকজন তাদের অনুসরণ করে বলেও কিছু অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উন্নয়নকর্মী জানান, স্থানীয় যুবকদের রোহিঙ্গা নারী বিয়ে করার ঘটনা অতীতে দেখা গেছে। তবে রোহিঙ্গা শিবির, বিশেষ করে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত শিবিরের রোহিঙ্গা যুবকদের সঙ্গে স্থানীয় নারীদেরও সম্পর্কে জড়ানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটি বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের উপস্থিতির কারণে স্থানীয়দের জীবনযাত্রায় যে প্রভাব পড়েছে তার মাত্রা নারীদের ওপর বেশি।

কক্সবাজার সরকারি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, উখিয়ার কোটবাজারের সাবিনা ইয়াছমিন বলেন, ‘সকালে গাড়িতে করে প্রতিদিন কলেজে যেতে হয়। আগে সকাল ৮টায় গাড়িতে উঠলেও ঠিক সময়ে কলেজে পৌঁছতে পারতাম। কিন্তু এখন এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর শত শত গাড়ি চলাচল করে। এ কারণে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে সব সময় যানজট লেগেই থাকে। এতে আমাদের মতো নারীদের যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।’

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা এলাকার গৃহিণী কুলসুমা বেগম বলেন, ‘আগের মতো হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছি না। ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে এখন অনেক লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। হাসপাতালে এখন স্থানীয় রোগীদের চেয়ে রোহিঙ্গা রোগীর সংখ্যাই বেশি।’ তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পের ভেতরে এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে রোহিঙ্গারা চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে চলে আসছে। এতে স্থানীয় নারীরা চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’

হোয়াইক্যং কাটাখালী গ্রামের শাকিরা আকতার বলেন, ‘অনেক রোহিঙ্গা নারী ক্যাম্প থেকে বাইরে পাচার হয় অথবা ক্যাম্পের বাইরে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া অনেক রোহিঙ্গা নারী ইয়াবা পাচারের সঙ্গেও জড়িত। এসব কারণে রোহিঙ্গা নারীদের শনাক্ত করার চেষ্টায় বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চেকপোস্টে স্থানীয় নারীদেরও জিজ্ঞাসাবাদের শিকার হতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণেই এখন আমাদের কোথাও যেতে হলে পথে পথে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের জেরার মুখে পড়তে হয়।’

উখিয়া উপজেলার বালুখালী এলাকার বিধবা নারী আছিয়া বিবি বলেন, ‘পাহাড়ের কিনারে গরু-ছাগল চরানোর পাশাপাশি শাক-সবজির চাষ করতাম। এতে আমার পরিবারের ভরণ-পোষণের পর বাজারে সবজি বিক্রি করে অনেক টাকা আয় হতো। কিন্তু রোহিঙ্গারা আসার পর এখন সেখানে গরু-ছাগল চরানোর মতো কোনো জায়গা নেই। মৌসুমি শাক-সবজির আবাদও বন্ধ হয়ে গেছে।’ আছিয়া বলেন, রোহিঙ্গারা পাহাড় ছেড়ে এখন স্থানীয়দের ফসলি জমিতে এসে চাষাবাদ শুরু করে দিয়েছে। আমরা আগে বিভিন্ন কাজকর্মে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি স্বাভাবিক চলাফেরার সুযোগ পেতাম। এখন সেটিও অনেক কমে গেছে।’

এ ব্যাপারে টেকনাফের নারী নেত্রী সনজিদা বেগম বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এ দেশে আসার ফলে আমাদের নারীদের বেশ অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো কখনো কাম্য ছিল না।’ তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে স্থানীয় নারীদের চিকিৎসার সুযোগ অব্যাহত রাখতে রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের আশ্রয়শিবিরেই চিকিৎসাসেবা বাড়ানো দরকার। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দাদের জমিতে রোহিঙ্গাদের যাতায়াত বন্ধ রাখা প্রয়োজন।

হোয়াইক্যং ইউনিয়নের আনোয়ারা বেগম জানান, রোহিঙ্গাদের কারণে তাঁর ক্ষেতখামার, নার্সারিতে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। জীবিকার তাগিদে তিনি এখন অন্যত্র ছুটছেন। একই ইউনিয়নের মনিরঘোনা এলাকার আলী আকবরের মেয়ে রুমানা আক্তার ও তাঁর স্বামী সৈয়দ আলম রোহিঙ্গাদের কারণে নার্সারি হারিয়ে চাকরি খুঁজছেন।

জানা গেছে, এসএসসি বা এইচএসসি পাস করেই অনেকে রোহিঙ্গা শিবিরে চাকরিতে যোগ দেওয়ায় তাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও স্বজনরা উদ্বিগ্ন। এনজিওগুলোর প্রকল্পের মেয়াদ শেষেই তারা চাকরি হারাবে। থাইংখালী রাহমতের বিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রুবিনা আক্তার বলেন, দরিদ্রতা ও অজ্ঞতার কারণে অনেক অভিভাবক তাঁদের মেয়েদের লেখাপড়া শেষ না করিয়ে চাকরিতে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। হোয়াইক্যং ফাঁড়ির সামনে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানি মনোয়ারা আক্তার সুমি জানান, রোহিঙ্গা আসাতেই ব্যবসা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বারবার সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

উনচিপ্রাং পুটিবনিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল জব্বারের স্ত্রী সুফিয়া বেগম বলেন, যুগ যুগ ধরে চাষাবাদ করে আসা জমিও এখন রোহিঙ্গাদের কারণে চাষ করা যাচ্ছে না। হোয়াইক্যং বিট কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক আহমেদ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে নারীদের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দুস্থ পরিবারগুলোর সংসারে বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও ঘটছে।

টেকনাফ উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলমগীর কবির জানান, স্থানীয় সম্প্রদায়ের নারীদের নানাভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নারী দিবসে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সীমান্ত উপজেলার নারীদের সমস্যা নিয়েও আলোচনা করা হবে। সেই সঙ্গে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে আগের তুলনায় অনেক বেশি হারে ‘ভিজিডি কার্ডের’ মাধ্যমে প্রতি মাসে নারীদের ৩০ কেজি করে চাল দেওয়ার কথাও জানান তিনি।

এ ব্যাপারে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসান জানান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে নারীদের সমস্যার কথা মাথায় রেখে নানাভাবে সহায়তা করছে সরকার। রোহিঙ্গা আসার আগে টেকনাফে মাত্র তিন হাজার ৪৬১ জন নারী ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে চাল পেত। এখন এ সংখ্যার সঙ্গে আরো ২০ হাজার ভিজিডি কার্ড দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নারীদের দুই মাসব্যাপী বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা হচ্ছে। সেলাই মেশিন, হাঁস-মুরগিসহ কারিগারি নানা যন্ত্রপাতি নারীদের বিতরণ অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

পাঠকের মতামত: