দেশ বিদেশ ডেস্ক :: দানাদার খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনকারী দেশ হয়েও খাদ্য নিরাপত্তাহীন দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার চাপে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট ফুড ক্রাইসিস-এর এক প্রতিবেদনে কক্সবাজারের ১৫ লাখ মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, সেখানকার ১৩ লাখ মানুষই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় বসবাস করছেন।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ২০১৮ সালের খাদ্য উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ধানের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হারে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে এখানে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আমন, আউশ ও বোরো মিলিয়ে বর্তমানে দেশে ধানের বার্ষিক ফলন ৩ কোটি ৬২ লাখ টনের বেশি। ভুট্টা উৎপাদন ছাড়িয়েছে ২৭ লাখ টন। আবহাওয়াগত কারণে গমের পাশাপাশি এক কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদন হচ্ছে দেশে। সবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনেও সাফল্য এসেছে। সব মিলিয়ে দানাদার খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এ অর্জন ম্লান হচ্ছে রোহিঙ্গা চাপে। রোহিঙ্গাদের কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীন দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। তবে গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস: জয়েন্ট অ্যানালাইসিস ফর বেটার ডিসিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এফএও বলছে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চারটি দেশে প্রায় ১ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ এরমধ্যে অন্যতম। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা এ অঞ্চলের বাকি তিনটি দেশ মিয়ানমার, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান।
প্রতিবেদনে খাদ্য নিরাপত্তাহীন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম আসার জন্য দায়ী করা হয়েছে রোহিঙ্গা সংকটকে। এতে বলা হয়, কক্সবাজারে শরণার্থীদের স্রোত বাংলাদেশে দরিদ্রতম ও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলায় একের পর এক ভঙ্গুর অবস্থা বাড়িয়েছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের চেয়ে স্থানীয়রা উচ্চমাত্রায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হচ্ছে। কক্সবাজারের ১৫ লাখ মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে এফএও বলেছে, জেলাটিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা ১৩ লাখ। এদের মধ্যে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা উভয় সম্প্রদায়ের সদস্যরাই রয়েছেন। তবে শরণার্থীদের ক্ষেত্রে এ সংকটের তীব্রতা বেশি। ফলে উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই খাদ্য সহযোগিতা প্রয়োজন। মূলত রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারের এমন পরিস্থিতিই বাংলাদেশকে খাদ্য নিরাপত্তাহীন দেশের তালিকায় যুক্ত করেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে শুরু হয় রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ। খুন-ধর্ষণ-সংঘবদ্ধ ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। এমন বাস্তবতায় নিধনযজ্ঞের বলি হয়ে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। আগে থেকে উপস্থিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দশ লাখে। এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে।
এফএও’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলায় খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি কেন খারাপ হচ্ছে, তার কারণও ব্যাখ্যা করেছে জাতিসংঘের সংস্থাটি। তারা বলছে, এমনিতেই দরিদ্র ও ভঙ্গুর জেলাগুলোর অন্যতম কক্সবাজার। রোহিঙ্গা বসতির কারণে স্থানীয় দরিদ্র জনগণের অনেকেই কৃষি জমিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। বন ও মাছ ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করতো, এ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারাও। বাধ্য হয়ে অনেককেই দিনমজুরের কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সস্তা শ্রমের কারণে দিনমজুরের কাজের সুযোগও স্থানীয়রা আগের মতো পাচ্ছে না। তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে দৈনিক মজুরিও কমে গেছে। বিপরীতে বাড়তি জনসংখ্যার চাপে বেড়ে গেছে খাদ্যমূল্য, যা সেখানকার দরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের জনবিন্যাসেও প্রভাব ফেলেছে। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট ফুড ক্রাইসিস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শরণার্থীদের ফলে বাড়তি জনসংখ্যার জন্য বাড়তি খাবারের চাহিদা তৈরি হয়েছে। ফলে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। মৌলিক অধিকার পূরণের ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ২০১৭ সালে পুওর বা বর্ডারলাইন ফুড কনজাম্পশন সীমায় অবস্থানরত স্থানীয় জনগোষ্ঠী ছিল ৩১ শতাংশ। ২০১৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ সময়ে তা বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন অভিযোগ করেছিল, ‘গণহত্যার উদ্দেশ্য’ নিয়েই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছিলো বর্মি সেনাবাহিনী। ওই কঠিন সময়ে সীমান্ত খুলে দিয়ে অসহায় এসব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এই সংকটের প্রভাবে এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কবলে পড়ছেন খোদ স্থানীয়রা।
পাঠকের মতামত: