ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

রিজার্ভ ব্যাংকের অর্থ লোপাট : গভর্নর দুই ডেপুটি গভর্নরসহ সাতজনকে অপসারণ

dollar_1অনলাইন ডেস্ক :::

বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সরে যেতে হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানকে। তাঁকে পদত্যাগ করতে বলা হলে তিনি গতকাল মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। প্রধানমন্ত্রীও তা গ্রহণ করেন।
পরে বিকেলে সরিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম ও নাজনীন সুলতানাকে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও দুজন নির্বাহী পরিচালক ও দুজন মহাব্যবস্থাপককে অপসারণেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাঁরা সবাই তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ (আইটি) এবং হিসাব বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। অন্যদিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমকে সরানো হয়েছে।
একই দিন নতুন গভর্নরও ঠিক করে সরকার। তিনি হলেন সাবেক অর্থসচিব মো. ফজলে কবির। তিনি সর্বশেষ সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদে ছিলেন। ফজলে কবির বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন।
এর আগে বিশ্বজুড়ে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ চুরির অনেক ঘটনা থাকলেও রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা আর তেমন নেই বলেই জানা গেছে। এটিকে সবচেয়ে বড় হ্যাকিংয়ের ঘটনাও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে। এ নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেও ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। নানা দিক থেকে চাপ তৈরি হলে পদত্যাগে বাধ্য হলেন গভর্নর। অর্থমন্ত্রীও গভর্নরকে আর চাচ্ছিলেন না। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। শীর্ষস্থানীয় সব কর্মকর্তাকে অপসারণের ঘটনাও আর ঘটেনি। বিষয়টি নিয়ে এখন সিআইডিও তদন্ত করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
যেভাবে গভর্নরের পদত্যাগ: গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে রিজার্ভ চুরির বিষয়ে আতিউর রহমানের দায়িত্বহীনতা ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে গোপন রাখার কারণে ব্যাপক সমালোচনা হয়। একই দিন আওয়ামী লীগের এক বৈঠকেও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এ সময় আতিউর রহমান দেশে ছিলেন না। ১০ মার্চ তিনি ভারতের দিল্লি যান এক সম্মেলনে অংশ নিতে। সোমবার বিকেলে দিল্লি থেকে দেশে ফিরে সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ে আসার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। তবে গোপনে তিনি রাতে অর্থমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে দেখা করে আসেন।
জানা গেছে, অর্থমন্ত্রীর বাসায় ওই সাক্ষাৎটি গভর্নরের জন্য সুখকর হয়নি। অর্থমন্ত্রী অনেকটা রূঢ়ভাবেই গভর্নরকে পরের দিন সকাল নয়টার মধ্যে পদত্যাগ করতে বলেন। অর্থমন্ত্রী আতিউরকে এ-ও বলেন, তিনি পদ ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক বরং ভালো চলবে। অর্থমন্ত্রীর বাসা থেকে ফিরে আতিউর রহমান রাতেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে সাড়া পাননি।
পরে আতিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বুঝতে পেরে গতকাল সকালে পদত্যাগপত্র লিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলে যান।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এর আগে গত সোমবার রাতে অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানেই আতিউর রহমানকে গভর্নর পদে না রাখার সিদ্ধান্ত হয়। একই সময়ে নতুন গভর্নর নিয়োগ নিয়েও আলোচনা হয়। তবে আরেকজন সাবেক অর্থসচিবকে গভর্নর পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর আগ্রহ ছিল। কিন্তু নামটি গ্রহণ করা হয়নি। এরপরই ফজলে কবিরের নামটি আরেকটি পক্ষ থেকে তোলা হলে প্রধানমন্ত্রী তাতে সম্মতি দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, আতিউর রহমান পদত্যাগ না করলে সংবাদ সম্মেলন করে গভর্নরকে অপসারণ করা হচ্ছে বলে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেবেন। এমনকি গভর্নর থেকে গেলে তিনি নিজেও পদত্যাগ করবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন। তবে সকালে গভর্নর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অর্থমন্ত্রীর পূর্বনির্ধারিত সকালের সংবাদ সম্মেলন পিছিয়ে বেলা আড়াইটা করা হয়। পরে সেটিও বাতিল করা হয়। জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ মহল থেকে সংবাদ সম্মেলন না করার জন্য অর্থমন্ত্রীকে বলা হয়েছে। এমনকি দলের অন্যদেরও এ বিষয় নিয়ে কম কথা বলার নির্দেশনা রয়েছে।
আতিউর রহমান সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এ সময়ের পরিবেশটি হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল। আতিউর রহমান এ নিয়ে তাঁর বাসায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র পেয়ে মর্মাহত হয়েছেন। তাঁর দুই চোখ দিয়ে পানিও পড়েছে। তারপর তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন।’ এ সময় আতিউর রহমান আরও বলেন, ‘মাথা উঁচু করে, বীরের মতো পদ ছেড়ে দিয়েছি। আমি তৃপ্তির সঙ্গে, মাথা উঁচু করে বিদায় নিতে পারছি। আমি চাইনি কোনো বিতর্ক হোক, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হোক। তাই নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র দিয়েছি।’ তিনি বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, অনুষ্ঠানটি পূর্বনির্ধারিত ছিল। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। তবে একে বড় ঘটনা ঘটানোর পটভূমি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
এদিকে অর্থমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন না করলেও অন্য একটি সভায় যোগ দিতে যাওয়ার সময় বিকেলে সাংবাদিকেরা অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, তাঁর বিবৃতি দেওয়ার কী হলো। জবাবে তিনি বলেন, এখন তো সব শেষ। বিবৃতি দেওয়ার আর কিছু নেই।
নতুন গভর্নর কে হচ্ছেন জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, এটা ঠিক করা হয়েছে। ঘোষণা আসবে। তিনি হলেন সাবেক অর্থসচিব ও সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলে কবির। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। ১৮ মার্চ তাঁর দেশে ফেরার কথা। দেশে ফিরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তির পর ফজলে কবির গভর্নর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দেবেন।
দুই ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি: বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভনর্রকে অব্যাহতি দেওয়া প্রসঙ্গেও অল্প কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। গতকাল পরিকল্পনা কমিশনে এনজিওগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রাক্-বাজেট আলোচনা শেষে অথর্মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘টু আর গন। তাঁদের জায়গায় নতুন ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হবে।’
ওই দুজন নাজনীন সুলতানা ও আবুল কাসেম কি না—জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ’। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘উনাদের নিয়োগ চুক্তিভিত্তিক। তাঁদের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।’
ব্যাংকিং সচিব আসলাম আলমকে কেন সরানো হলো—জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি (আসলাম আলম) ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব। তাই তাঁকে সরানো হলো। আসলাম আলমের জায়গায় শিগগির আরেকজনকে দেওয়া হচ্ছে বলে জানান মুহিত।
একই ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই নির্বাহী পরিচালক ও দুই মহাব্যবস্থাপককেও অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ফজলে কবির কাজ শুরুর পর এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হবে।
তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি: রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে গতকাল তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
কমিটির সদস্যসচিব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগেরই অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস। অপর সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। কমিটি চাইলে অতিরিক্ত সদস্য এবং বিশেষজ্ঞ সেবা নিতে পারবে।
কমিটিকে এক মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন এবং ৭৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির কর্মপরিধির মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে এই অর্থ কীভাবে ও কার বরাবর গেল, অবৈধ পরিশোধ ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিয়েছে, বিষয়টি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন রাখার যৌক্তিকতা কী, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কি না, অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা কতটুকু, একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে করণীয় কী ইত্যাদি।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। ফিলিপাইনের একটি পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি জানাজানি হয়।
গভর্নরের পদত্যাগ ও দুই ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে থাকলেন দুজন ডেপুটি গভর্নর। তাঁরা হলেন আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান ও এস কে সুর চৌধুরী।

পাঠকের মতামত: