ঢাকা,সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

মেঘে ঢাকা সাগর-রুনির মেঘ!

বাংলাট্রিবিউন :::

‘ছেলেটা এখনও ভাত মেখে গুছিয়ে খেতে শেখেনি। মেখে দিলে সুন্দর করে খায়। আমার কাছেই থাকে ছোট থেকে। কিন্তু এখনও ক্ষুধা লাগলে মুখ ফুটে বলে না, খাবো।’ নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির একমাত্র সন্তান মেঘকে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রুনির মা নুরুন্নাহার মির্জা। মেঘ এখন সাড়ে দশ বছরের। বাবা-মাকে হারিয়ে পাঁচটি বছর কাটিয়েছে হাসি কান্নার কাব্যে, তবে কষ্টের মেঘ এখনও কাটেনি। মেঘ প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে বলে জানান রুনির মা।

কিশোর হতে চলা মেঘকে স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে রেখেছেন স্বজনরা। কেউ তার সামনে মা-বাবা নিয়ে কিছু বলেন না, যদি কষ্ট পায় কোনও কথায়। নুরুন্নাহার বলেন, ‘ওর বাবা মাকে নিয়ে আমরা কোনও কথা না বললে কী হবে! বাসার বসার ঘরে দেয়ালজুড়ে সাগর রুনির বড় বড় ছবি। ও জানে, কে বা কারা ওর বাবা মাকে মেরে ফেলেছে। সবাই বাবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে যায়। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি ওকে ভুলিয়ে রাখতে।’

 অন্য শিশুদের মতো মেঘেরও তার বাবা-মাকে ঘিরে ছিল আপন ভুবন। তার নানি বলেন, ‘সাগরের কাছে মেঘের চাওয়া ছিল সবার ওপরে। গভীর রাতে সন্তান কিছু চাইলে আমরা পরেরদিন দেবো বলে থাকি। কিন্তু রাত ২টায় ঘুম ভেঙে যদি বাবাকে বলতো, কালোজাম খাবো, সেই রাতেই সাগর বের হয়ে যেত মিস্টি নিয়ে আসতে। বেশিদিন কাছে থাকবে না বলেই হয়তো, কে জানে! সেই ছেলে এখন মুখ ফুটে বলে না কিছু খাবো।’.

সাগর সরওয়ারের সঙ্গে তার ছেলে মেঘপাঁচ বছর আগে ২০১২ সালের এইদিনে ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাড়িতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। সাগর তখন মাছরাঙা টেলিভিশনে আর রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। তাদের ৬ বছরের সন্তান মেঘ ঘটনার সময় সেই বাসাতেই ছিল। কীভাবে নানিকে ফোন করে জানালো মৃত্যু সংবাদ, কীভাবে দরজা খুলে দিল তার কোনও কথাই সে জানাতে পারেনি সে। মনের মধ্যে ক্ষত নিয়ে বড় হতে থাকা মেঘ কখনও সেদিনটা নিয়ে কাউকে প্রশ্ন করে না।

এখন কেমন আছে সাগর-রুনির একমাত্র ছেলে মেঘ— প্রশ্ন করতেই নুরুন্নাহার মির্জা বলেন, ‘আমরা বড়রাই এখনও নিজেদের মনকে বোঝাতে পারছি না, আর মেঘ তো কোলের শিশু। আমার কিছু ভালো লাগে না আজও। জলজ্যান্ত ছেলেমেয়ে দুটো খুন হলো, কীভাবে হলো জানতে পারলাম না।’

ঈদে, জন্মদিনে কিংবা ১১ ফব্রুয়ারি যখন সব গণমাধ্যম সাগর-রুনির হত্যার খবর আবারও প্রচার প্রকাশ করে তখন মেঘ বাবা-মায়ের কথা কিছু জানতে চায় কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে মেঘের নানি বলেন, ‘না, ও অন্যরকম। ওকে অন্যরকম হতে হয়েছে। কখনোই কিছু জানতে চায় না। বাবার মতো হয়েছে, ভীষণ চাপা স্বভাবের।’  .

মামা নওশের নোমান গত পাঁচ বছর ধরেই মেঘের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। মেঘের সব আবদারও যেন তাকে ঘিরেই। বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত কিংবা মায়ের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ে ঘুরতে যাওয়া মামার সাথেই। কেমন আছে মেঘ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে’। আরও জানান, বাবা-মা কে হারিয়ে তদন্তে সহযোগিতা করতে গিয়ে ছোট্ট মেঘকে অনেক চাপ নিতে হয়েছে। মামা বলেন, ‘ওকে কতভাবে প্রশ্ন করেছে, কাউন্সিলিং এর জন্য নিয়ে যেতে বলেছে, আমরা গিয়েছি। বাবা-মাকে হারানোর পরপর সে একেবারেই স্বস্তির সময় পায়নি। তদন্তের নামে ছেলেটি এই ঘটনার মধ্যেই থেকেছে দীর্ঘ সময়। আমরা চাই ওর স্বাভাবিক জীবন। ও যেন সেরা জীবনটা পায়।’

এদিকে সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির জানান, ‘মেঘ বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত। চারপাশের পরিস্থিতি ওকে এমন করে দিয়েছে। নানী মামার সাথে ও স্বস্তিতে থাকে, থাকুক। আমার ছেলের স্মৃতিচিহ্নের মুখটাই বারবার মনে করে বুকে পাথর নিয়ে অপেক্ষায় থাকি, বেঁচে থাকতে বিচারের বাণী শুনতে পাবোতো?’

 

পাঠকের মতামত: