মালয়েশিয়ায় আবারও বৈধ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে অবৈধভাবে বসবাসরত সাড়ে তিন লাখ বাংলাদেশিসহ বিদেশি শ্রমিকরা। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক গত বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে ঘোষণা দিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় যত অবৈধ শ্রমিক রয়েছে তাদের বৈধতা দেওয়া হবে। এ ঘোষণার পর কুয়ালালামপুর, জোহর বাহরু, মালাক্কা, পাহাং, পেনাংসহ প্রায় প্রতিটি প্রদেশে থাকা অবৈধ বাংলাদেশিরা এখন বৈধ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর।
এদিকে বৈধ করে দেওয়ার কথা বলে মালয়েশিয়ায় এক ধরনের সিন্ডিকেট প্রবাসীদের কাছ থেকে পাসপোর্টসহ টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। অনেকেই না জেনেবুঝে এই দালাল সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ছে। এ ধরনের দালালদের কাছে টাকা বা পাসপোর্ট না দিতে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। যেখানে বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার লাখ বাংলাদেশি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত। মালয়েশিয়া থেকে আমাদের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশভিত্তিক রেমিট্যান্সের তালিকায় পঞ্চম বৃহত্তম। সেখানে অবৈধ প্রবাসীদের বৈধ করার ঘোষণা দিয়েছে সে দেশের সরকার। আমরা বিষয়টি নিয়ে দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এই সুযোগটি যেন সব অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশি কাজে লাগাতে পারে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ যাতে দালাল না ধরে সরাসরি হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।’
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমি শিগগিরই মালয়েশিয়া সফরে যাব, একজন প্রবাসী বাংলাদেশিও যেন হয়রানি কিংবা প্রতারণার শিকার না হয় সে বিষয়ে আমরা কাজ করব। তবে এবারের বৈধকরণ প্রক্রিয়া হবে অনলাইনে।’
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের হাইকমিশনার শহীদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক তাঁদের সংসদে ঘোষণা দিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত অবৈধ যত শ্রমিক রয়েছে তাদের বৈধতা দেওয়া হবে। তবে কত দিনের মধ্যে অবৈধরা বৈধ হতে পারবে, সে ব্যাপারে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।’
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে দুষ্ট লোকের সংখ্যা বেশি। বৈধ করার কথা বলে এক ধরনের প্রতারক প্রবাসীদের টাকা এবং পাসপোর্ট নিয়ে চলে যায়। ফলে তারা বৈধ হতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়। এর আগে মালয়েশিয়া সরকার অবৈধদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। তখন বহু শ্রমিকের পাসপোর্ট-টাকা নিয়ে দালালরা সটকে পড়ে। এবার যাতে তারা কোনো দালালের সঙ্গে যোগাযোগ না করে সরাসরি আমাদের হাইকমিশনে যোগাযোগ করে।’
২০০৮ সালে হঠাৎ মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। একইভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব ও আরব আমিরাতেও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া প্রায় বন্ধ থাকে। ওই অবস্থায় মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর নামে দুই দেশে মানবপাচারকারীচক্র গড়ে ওঠে। ওই চক্রের সদস্যরা গ্রামের সহজ-সরল লোকজনকে স্টুডেন্ট ও ট্যুরিস্ট ভিসার নামে মালয়েশিয়া পাঠানো শুরু করে। শুধু তাই নয়, সমুদ্রপথে কক্সবাজারের টেকনাফসহ বেশ কয়েকটি পথে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে মালয়েশিয়ার কর্মী পাঠাতে শুরু করে। এভাবে কয়েক বছরে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মী যায় মালয়েশিয়ায়। এতে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। থাইল্যান্ড আর মালয়েশিয়ার সীমান্তে পাওয়া যায় মানুষের গণকবর। আর কোনো মতে মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর কোনো পাসপোর্ট ভিসা না থাকায় অবৈধ হয়ে বনে-জঙ্গলে এবং পুলিশের চোখ এড়িয়ে বিভিন্ন কারখানা কিংবা বাসাবাড়িতে বসবাস করছে তারা। অভিবাসীদের ধরতে প্রতিদিনই বিভিন্ন মার্কেট ও কারখানায় অভিযান চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে অভিযানে প্রায় তিন হাজার প্রবাসীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। এ পরিস্থিতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে অবৈধ প্রবাসীরা।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ কমিউনিটির নেতা মুকুল আহমেদ বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার সরকার অবৈধ প্রবাসীদের বৈধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর অবৈধ প্রবাসীদের ধরপাকড়ও অনেকটা কমে গেছে। বাংলাদেশি প্রবাসী ভাইয়েরা যেন কোনো ধরনের হয়রানি কিংবা প্রতারণার শিকার না হয় সেই বিষয়ে আমরা সতর্ক। এবার যাতে সবাই বৈধ হওয়ার সুযোগ পায় সে ব্যাপারে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ কমিউনিটির পক্ষ থেকে হাইকমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, এর আগে ২০১১ সালের ১৫ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত মালয়েশিয়া সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দুই লাখ ৬৮ হাজার ৮৮৩ জন অবৈধ বাংলাদেশি কর্মী বৈধতা লাভের সুযোগ পেয়েছিল।
পাঠকের মতামত: