খুলনা অফিস :
এলাকার নোংরা রাজনীতির কারণে একের পর এক মামলা-নির্যাতনে মজনুকে বাড়ি ছাড়তে হয়। খুলনা মহানগরীর খালিশপুর এলাকার আক্কাসের মাধ্যমে ১০ বছর আগে তিনি বনদস্যু বাহিনীতে যোগ দেন। এরপর একে একে সদস্য যোগাড় করে নিজেই গড়ে তোলেন দুর্ধর্ষ মজনু বাহিনী। মজনু গাজী বলেন, আমরা ভুল করেছি, সামাজিক-রাজনৈতিক চাপে আমরা এই চরমপথ বেছে নিয়েছিলাম। এখন আমরা ভালো হয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চাই।
যেভাবে বেবিট্যাক্সি চালক থেকে বনদস্যু বাহিনী প্রধান : দুর্ধর্ষ বনদস্যু বাহিনী প্রধান মজনু গাজী খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর থানাধীন পাবলা সবুজ সংঘ মাঠ এলাকার বাসিন্দা আমীর আলী গাজীর ছেলে। তার গ্রামের বাড়ি খুলনা জেলার কয়রায়। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। বেবিট্যাক্সি চালিয়ে এক সময় সংসার চালাতেন। অভাবের সংসারে টানাপড়েন লেগেই থাকত। মজনু ভালো বেবিট্যাক্সি চালাতেন। এক সময় তিনি সুন্দরবনে যাওয়া শুরু করেন। ধীরে ধীরে মজনুর দস্যু হয়ে ওঠার খবর আসতে থাকে। এ অবস্থায় তারা কয়রা ছেড়ে খুলনায় চলে আসেন। তার এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তার পিতা আমীর আলী গাজী, বোন ইরানী বেগম, স্ত্রী রেশমা, ছেলে চয়ন ও মেয়ে সেতু ওরফে শিলা এবং এক ভাগ্নি উপস্থিত ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলী তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করা মজনু গাজী বলেন, এলাকার নোংরা রাজনীতির কারণে একের পর এক মামলা-নির্যাতনে তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়। খালিশপুর এলাকার জনৈক আক্কাসের মাধ্যমে ১০ বছর আগে তিনি বনদস্যু বাহিনীতে যোগ দেন। এরপর একে একে সদস্য যোগাড় করে নিজেই গড়ে তোলেন দুর্ধর্ষ মজনু বাহিনী। গত কয়েক বছর ধরে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ (খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চল) ও বঙ্গোপসাগরে অপহরণ, ডাকাতি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে তার বাহিনী। বনের মধ্যে অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তোলে। জেলে-বনজীবীদের জিম্মি ও নির্যাতন করে অর্থ আদায় করে।
মজনু গাজী বলেন, তারা ভুল করেছে, সামাজিক-রাজনৈতিক চাপে তারা এই চরমপথ বেছে নিয়েছিলেন। এখন তারা ভালো হয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে যায়।
বাহিনী প্রধান মজনু গাজী বলেন, সুন্দরবনে থেকে পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তানকে দেখতে মন চাইলেও তাদের কাছে আসা যেত না। বনের মধ্যে র্যাব, নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ড, ফরেস্টারসহ প্রতিপক্ষ ডাকাত বাহিনীর ভয় আর সুন্দরবন থেকে বাড়িতে আসতে চাইলে স্থানীয় শত্রুদের ও পুলিশের ভয়। সম্প্রতি র্যাব, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ক্রস ফায়ারে বিভিন্ন বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা নিহত হওয়ার খবর পেয়ে জীবন বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তবে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার সংবাদ পেয়ে স্বাভাবিক জীবনের আসায় ফিরে এসেছি। স্বাভাবিক জীবনে গিয়ে যেন আবারো কোন নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে না হয় এ বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।
দুই ভাই-বোন কখনো বাবার আদর পায়নি : মজনুর একমাত্র মেয়ে খুলনার সরকারি বিএল কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সেতু (১৯)। প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকে এক অজানা আতঙ্কে ভুগতে ছিলেন তিনি। কারণ তার বাবা কোথায় যেন থাকতেন! কয়েক মাস পর পর রাতের আঁধারে বাড়িতে এসে কয়েক ঘন্টা থেকে আবারো চলে যেতেন। অনেক সময় গভীর রাতে বাবা এসে আবারো চলে যেতেন ঘুমিয়ে থাকার কারণে বাবাকে আর দেখা হতো না, সকালে মায়ের মুখে শুনতেন বাবা এসেছিলো।
আবেগঘন কণ্ঠে তিনি বললেন, বাবা দস্যুদলে আছে বলে স্বজনদের অনেকেই তাদেরকে হেয় করে দেখতো। সকলে তাদের বাবাকে নিয়ে কত আনন্দ করতো, কিন্তু তারা দুই ভাই-বোন কখনো বাবার আদর পায়নি। আজ তাদের বাবা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আত্মসমর্পণ করেছেন, আজ তাদের সবচেয়ে আনন্দের দিন।
মজনু গাজীর মেয়ে সেতু আরো জানান, পত্র-পত্রিকায় ও টেলিভিশনে যখন দেখতাম সুন্দরবনে র্যাব, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে বনদস্যু নিহত হয়েছে তখন মনটা কেঁদে উঠতো। দীর্ঘ সময়ের পর বাবার এ সিদ্ধান্তকে সারা জীবন শ্রদ্ধা ভরে মনে রাখবো। তিনি তাদের পরিবারের ১২/১৩ বছরের কালো অধ্যায়কে বিদায় জানিয়েছেন।
সেতু’র বড় ভাই চয়ন গাজীও বিএল কলেজের অনার্সের ছাত্র। স্কুল-কলেজের সহপাঠিদের কাছে তারা দু’জনে তাদের বাবা কি পেশায় আছেন বলতে লজ্জা পেতেন। বাবাকে নিয়ে কোন প্রসঙ্গ উঠলে তারা এড়িয়ে যেতেন। তবে এখন তাদের সেই ভয়, লজ্জার দিন শেষ। তাদের বাবা এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।
চয়ন গাজী আরো বলেন, বাবার আদর ভালবাসা কখনো ভালভাবে পায়নি। পড়াশুনার মাঝে বাবাকে সব সময় মিস করতাম। বাবা’র পেশা সম্পর্কে বন্ধু মহলে সহপাঠিদের কিছু বলতে পারতাম না। মা ও দাদুর মুখে শুনেছি ঐ পেশায় যাওয়ার পেছনে বাবা বাধ্য হয়েছিলেন। স্থানীয় জনৈক প্রভাবশালী একজন ব্যক্তির নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি অন্ধকারের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
মজনুর ছোট ভাই মো. মজিদ গাজী বলেন, মজনু ভাল বেবিট্যাক্সি চালাতো। নিজস্ব গাড়ি চালাতে চালাতে এক পর্যায়ে সে সুন্দরবনে যাওয়া শুরু করে। এরপর থেকে সুন্দরবনেই থাকতে শুরু করে। ধীরে ধীরে মজনুর দস্যু হয়ে ওঠার খবর আসতে থাকে। তিনি বলেন, তাদের মা ফজিলা খাতুন মজনুর ভাবনায় অস্থির থাকতেন। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মজনুর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরিতে তারা খুবই আনন্দিত। গত সপ্তাহে মজনু বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণের কারণে র্যাবের হেফাজতে যায়। এরপর থেকে তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন। শুক্রবার প্রকাশ্যে অনুষ্ঠান হওয়া এবং মজনুকে ভাল দেখার পর তারা আরও বেশি আনন্দিত হয়েছেন।
মজনুর বোন ইরানী বেগম জানান, সংসারে অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এ অবস্থায় সহজেই আয় রোজগারের জন্য মজনু সুন্দরবনে যায়। তখন থেকেই ভাই আমার ধীরে ধীরে দস্যু হয়ে ওঠে। আমরা বুঝিয়েও তাকে ফেরাতে পারিনি। এখন সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারার সুযোগ পাওয়ার তারা আনন্দিত।
মজনু’র বয়োবৃদ্ধ পিতা আমীর আলী গাজী বলেন, তার ছেলে সামাজিকভাবে নির্যাতিত হয়ে এ পেশায় গিয়েছিলো। এখন সব কিছু ছেড়ে আত্মসমর্পণ করেছে। সরকারের কাছে দাবি যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে সে ব্যবস্থা করা।
যেভাবে আত্মসমর্পণে : খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মোহাম্মদ আলীর ‘কাউন্সিলিং’ এ মজনু বাহিনীর প্রধানসহ নয় সদস্য আত্মসমর্পণ করে। মজনু গাজীর দুই ছেলে-মেয়ে একসময় তার স্কুলেই পড়তো। সেই সূত্রে পরিবারটির সাথে সামাজিক সম্পর্ক ছিল শেখ মোহাম্মদ আলীর। তিনি বললেন, গত ৩১ মে আরেক বনদস্যু মাস্টার বাহিনী মংলায় আত্মসমর্পণ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, সুন্দরবনে দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাইলে অন্য বাহিনীর সদস্যরাও এই সুযোগ পাবেন। তারপর থেকেই তিনি পরিবারটির সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। প্রথমে মজনু গাজীর স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ের সাথে কথা বলেন। তারপর তাদের মাধ্যমে মোবাইলে কথা হয় দস্যু প্রধান মজনু গাজীর সাথে। এক পর্যায়ে মজনু ও তার বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকারের নিশ্চয়তা চায়। এরপর শেখ মোহাম্মদ আলী যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মহসিন উল হাকিমের মাধ্যমে র্যাব কর্মকর্তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। দু’পক্ষের আলোচনার পর আত্মসমর্পণের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়। সর্বশেষ গত ১৫ জুলাই শুক্রবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে বনদস্যু ‘মজনু বাহিনী’র প্রধান মজনু গাজী তার নিজ বাহিনীর আটজন সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় তারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলী জমা দেন।
‘মজনু’ ও ‘ইলিয়াছ’ বাহিনীর ১১ সদস্যের বিরুদ্ধে দুটি মামলা : দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আত্মসমর্পণ করা সুন্দরবনের ‘মজনু’ ও ‘ইলিয়াছ’ বাহিনীর ১১ সদস্যের বিরুদ্ধে খুলনার দাকোপ থানায় দুটি মামলা হয়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব-৮) উপ সহকারী পরিচালক (ডিএডি) আমজাদ হোসেন বাদি হয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা দু’টি দায়ের করেন। শনিবার দুপুরে আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের খুলনার বিচারিক হাকিম আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। দাকোপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাসির উদ্দিন বলেন, আত্মসমর্পণ করা ১১ দস্যুকে শুক্রবার রাতে দাকোপ থানায় হস্তান্তর করে র্যাব। তাদের জমা দেয়া ২৫টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র এবং এক হাজার বিশ রাউন্ড গুলি থানায় জমা দিয়ে র্যাবের পক্ষ থেকে দু’টি মামলা করা হয়েছে।
আত্মসমর্পণকারীরা শিগগিরই পুনর্বাসিত হবে : র্যাব-৮’র অধিনায়ক লে. কর্নেল ফরিদুল আলম বলেছেন, ইতোমধ্যেই মাস্টার বাহিনীর ১০ জন আত্মসমর্পণ করেছে। তাদেরকে রিমান্ডে নেয়া হয়নি। তারা শিগগিরই মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। সে প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এদেরকে জমি কিনে দেয়া, ক্ষুদ্র ব্যবসার সুযোগ করে দেয়া অথবা যোগ্যতা অনুসারে প্রয়োজনীয় গাড়ি কিনে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পরে আলাপকালে এ সব কথা বলেন। তিনি বলেন, শুক্রবার আত্মসমর্পণকারী ১১ জনের জন্য একই ব্যবস্থা থাকবে। প্রয়োজন হলে কারও জন্য আরও ভিন্নতর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, ইলিয়াছ ও মজনু বাহিনীর ১১ জন আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু এ দুই বাহিনীর আরও ২৬ জন সদস্য বাইরে সক্রিয় রয়েছে। তাদের বিষয়ে গোয়েন্দা নগরজারি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সুন্দরবনে বর্তমানে সাগর বাহিনীসহ এখনও ছয়টি বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে সাগর বাহিনীটি বড়। এ বাহিনীর সদস্যদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া চলছে। যা হতে পারে আত্মসমর্পণের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ। দস্যুরা সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র লুকিয়ে রাখে। যা ওদেরই জানা থাকে। এ অস্ত্র স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে ভাড়া হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। র্যাব এসব অস্ত্রের মালিকদের সন্ধান পেয়েছে। খুব শিগগিরই এদের মুখোশ উন্মোচন করা শুরু হবে। তিনি বলেন, গভীর সমুদ্রে অভিযান পরিচালনা করার মত জলযান র্যাবের নেই। তাই, নৌবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে গভীর সমুদ্রে র্যাবের অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি সুন্দরবনে চলমান অভিযান আরও কঠোর করা হচ্ছে। র্যাব-৮ এর অধিনায়ক বলেন, সুন্দরবনের দস্যুদের অন্যতম রাজু বাহিনীর প্রধান রাজু বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজু ভারতে ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত। তারপরও রাজুর ব্যাপারে র্যাব সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
র্যাব হেড কোয়াটারের পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) মুফতি মাহমুদ বলেন, র্যাব এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক বনদস্যু সদস্যকে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। এ সময় ৩৫০টি অস্ত্র এবং ১০ হাজার রাউন্ডেরও বেশি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। তবে অন্য দস্যুরাও আত্মসমর্পণ করলে তাদের স্বাগত জানানো হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
র্যাব ৮ এর কমান্ডার জসিম উদ্দিন বলেন, সুন্দরবনে অভিযান পরিচালনা এবং আত্মসমর্পণসহ সার্বিক প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরণের সহযোগিতা কেন্দ্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এর হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে নিরূপন করা সম্ভব নয়। সোর্সদের জন্য পর্যাপ্ত সোর্সমানি রয়েছে। আর আত্মসমর্পণকারীদের পুনর্বাসনের জন্যও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে।
গত ৮ বছরে সুন্দরবনে র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে ৮৮ বনদস্যু নিহত : সুন্দরবনে র্যাব-৮ এর সাথে বন্দুকযুদ্ধে গত ৮ বছরে ৮৮ বনদস্যু নিহত হয়েছে। এ সময় উদ্ধার করা হয় ৫১৮টি আগ্নেয়াস্ত্র। এছাড়া বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে কয়েকশ’ বনদস্যুকে গ্রেফতার করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। এসব কর্মকান্ডে জেলে-বাওয়ালীদের কাছে বনবিভাগ বা কোস্টগার্ডের চেয়ে র্যাব অতি অল্প সময়ে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তবে বন্দুকযুদ্ধে বনদস্যুদের বাহিনী প্রধানরা নিহত হলে দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড বা প্রভাবশালী সদস্যরা নতুন নামে একাধিক দস্যু বাহিনী গঠন করে সুন্দরবনে ডাকাতি অব্যাহত রাখে। গত এক বছরে সুন্দরবনে বনদস্যুরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। দস্যুরা জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় শুরু করে। চাঁদার টাকা না পেলে তারা ট্রলারে হামলা চালিয়ে জাল ও মাছ লুট এবং জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতে থাকে। দস্যুদের বেপরোয়া তান্ডবের কারণে সাগর ও বনের ওপর নির্ভরশীল জেলেরা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এর ফলে সুন্দরবনে বেড়ে যায় র্যাবের অভিযানের মাত্রা। বন্দুকযুদ্ধে একের পর এক নিহত হতে থাকে বনদস্যু বাহিনীর প্রধানসহ তাদের সহযোগিরা। এতে করে সুন্দরবনের বনদস্যুদের মধ্যে র্যাব আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দিশেহারা এ সব বনদস্যুদের কাছ থেকে আসতে থাকে আত্মসর্মপণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবার প্রস্তাব। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৩১ মে ‘মাস্টার বাহিনী’র ১০ সদস্য ৫১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও পাঁচ হাজার রাউন্ড গুলীসহ আত্মসর্মপণ করে। আর এই আত্মসমর্পণের মধ্যেদিয়ে সুন্দরবনের দস্যুতার এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়।
র্যাব-৮ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ফরিদুল আলম বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাব-৮ সুন্দরবনে দস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এ পর্যন্ত ৪০ জনেরও বেশি বনদস্যু বাহিনী প্রধানসহ অসংখ্য বনদস্যু বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে পাঁচ শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র। এছাড়া গত ৩১ মে সুন্দরবনের কুখ্যাত বনদস্যু মাস্টার বাহিনীর ১০ সদস্য আত্মসমর্পণ করে। তিনি বলেন, জেলেদের খবর অনুযায়ী পূর্ব সুন্দরবন এখন দস্যুমুক্ত। তবে পশ্চিম সুন্দরবনে এখনও কিছু বনদস্যু বাহিনী রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সুন্দরবনে বনদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য মোটিভেশন দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছু বাহিনীর প্রধান আত্মসর্মপণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য যোগাযোগ করেছে। তাদের আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সহযোগিতা করা হবে। আর যারা ফিরে আসবে না, তাদের বিরুদ্ধে র্যাব কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সাইদুর রহমান বলেন, বিশাল আয়তনের এ সুন্দরবনের সুরক্ষার জন্য সীমিত সংখ্যক বনরক্ষী রয়েছে। তারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে র্যাবের অভিযানের ফলে সুন্দরবনে বনদস্যুদের তৎপরতা অনেকাংশে কমে গেছে। এটি বনজীবী ও মৎস্যজীবীদের জন্য একটি খুশির সংবাদ।
এদিকে সুন্দরবনে একের পর এক বনদস্যু বাহিনী প্রধানসহ শতাধিক বনদস্যু নিহত হলেও থেমে নেই জেলে-বাওয়ালী অপহরণ। আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপনের বিপুল পরিমাণ টাকা। গত দুই বছরে র্যাব, পুলিশ ও কোষ্টগার্ডের সফল অপারেশনে প্রায় অর্ধশত বনদস্যু নিহত হয়। এই হতাহতের পর আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সুন্দরবন সংলগ্ন সাগরে নিয়োজিত জেলেরা সুন্দরবনে যাতায়াত নির্বিঘ্ন হবে বলে মনে করেছিল। কোন ভাবেই দমানো যাচ্ছে না সুন্দরবনের বনদস্যু বাহিনীকে। নতুন নতুন বাহিনী গঠন করে বনদস্যুরা এখনও করছে রাম রাজত্ব।
নতুন নতুন বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে সুন্দরবনে অপহরণ ও মুক্তিপনের বিষয়ে র্যাব-৬ এর স্পেশাল কোম্পানী কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন জানান, জেলে-বাওয়ালী ও পর্যটক বান্ধব সুন্দরবন গড়তে সুন্দরবনের বনদস্যুদের দমনে র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা গুলোর অধিবাসীদের অধিকাংশই তাদের জীবিকা নির্বাহের কেন্দ্রস্থল এই সুন্দরবন। ঐশ্বর্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর জীব বৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনে পর্যটক আগমনও বৃদ্ধি পেয়েছে। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পিরোজপুর ও ভোলা জেলার কয়েক লাখ উপকূলীয় মানুষ বিগত কয়েক দশক ধরে সুন্দরবনে মধু, কাঠ, গোলপাতা, চিংড়ির পোনা, কাঁকড়া, সাদা মাছ ও শুটকি আরোহন করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে এসকল মানুষ প্রতিনিয়তই জীবন যুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে বনদস্যুদের অপতৎপরতা। প্রায় দুই যুগ ধরে বনদস্যুদের অপতৎপরতা সুন্দরবন কেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সীমাহীন দুর্ভোগ আর আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বনদস্যুদের এই অপতৎপরতার কারণে অনেক জেলে-বাওয়ালী জীবন ভয়ে এবং মুক্তিপনের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছে।
পাঠকের মতামত: