ঢাকা,বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪

মক্কা-মদিনাতেও হাজীদের সঙ্গে এজেন্সির প্রতারণা, ফিরে আসা হাজীদের মুখে দুর্ভোগের বর্ণনা

mokkaগত চার দিন হলো দেশে ফিরছেন হাজিরা। হাজিদের অনেকেই পবিত্র মক্কা-মদিনায় অসাধু হজ এজেন্সি ও স্থানীয় মোয়াল্লেমদের চরম অব্যবস্থাপনা ও প্রতারণার যে বর্ননা দিচ্ছেন তা রীতিমত মর্মস্পর্শী। কেউ কেউ এয়ারপোর্টে নেমে কেঁদে ফেলছেন। তারা প্রতারক এজেন্সির বিচার দাবি করছেন। উন্নত মানের বাসা, স্বাস্থ্যসম্মত ভালো খাবার ও গাইড খরচের নামে এজেন্সিগুলো নানা কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিলেও কাংখিত সেবা পাননি হাজীরা।

অভিযোগ উঠেছে, চিকিত্সা ও পরিবহন সুবিধাসহ যেসব সুযোগ-সুবিধা হাজীদের দেওয়ার কথা ছিলো তা দেওয়া হয়নি। তাদের যে ধরনের বাড়িতে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সৌদি আরবে নেওয়া হয়, বাস্তবে তা হয়নি। রাখা হয় অত্যন্ত নিম্নমানের ঘরে, গাদাগাদি করে। পবিত্র কাবা শরিফের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়ার কথা বলে তাদের রাখা হয় দূরবর্তী স্থানে। গাড়ির কথা বললেও সেখানে গাড়ি দেওয়া হয়নি। গাইডের অভাবেও অপরিচিত জায়গায় হাজিদের অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

আবার কিছু এজেন্সির বিরুদ্ধে হজ যাত্রীদের খাবার না দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এজেন্সিগুলো খাবার সরবরাহ বাবদ অর্থ নিলেও হাজিদের নির্ভর করতে হয়েছে বাইরে থেকে কিনে আনা খাবারের ওপর। আবার অনেকে দেশ থেকে নেয়া চিড়া মুড়ি খেয়েই দিন পার করেছেন।

কেউ কেউ সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মক্কায় বাংলাদেশের হজ অফিসে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। বাংলাদেশ থেকে যে সব কর্মকর্তা হাজীদের সেবার কথা বলে সৌদি আরব গিয়েছিলেন তাদেরও খোঁজ পাননি কোন হাজী।

শুক্রবার ও গতকাল শনিবার বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সাথে এই সব বহুমাত্রিক দুর্ভোগের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কয়েকজন হাজি। হাজি জোহরা খাতুন কান্না বলছিলেন, তাদের যেখানে রাখা হয়েছিলো সেটা ছিলো খুবই নোংরা ভবন। দুর্গন্ধে বমির উদ্রেগ করতো। তাদের কাফেলার সব হাজিদের ডায়ারিয়া হয়েছিলো।

জোহরা খাতুনরা হজ এজেন্সি কে আই ট্রাভেলসের (লাইসেন্স নম্বর ৮৬৬) মাধ্যমে হজে যান। তারা এক সঙ্গে থাকা ৫৬ জন হাজিকে এমন দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। তাদের কয়েকজনকে আবার রাখা হয় একটি ভবনের আন্ডার গ্রাউন্ডে। যেখানে কোনো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা ছিলো না। এমনকি মোবাইলের নেটওয়ার্কও ছিলো না। ভবনের মধ্যে এমন গরম যে অনেকের শরীরে ফোসকা পড়ে গেছে।

কে. আই. ট্রাভেলসের মোয়াল্লেম মশিউর রহমান রায়হান হাজিদের ধরাছোয়ার বাইরে ছিলো। বার বার রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন হাজীরা। ট্রাভেলসের মালিক ছিলো লাপাত্তা।

হাজী আনোয়ারা বেগম জানান, তাদেকে কবুতরের পায়খানার ঘরে রাখা হয়েছিলো। তার বয়স্ক স্বামী মারা যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিলো। তিনি বলেন, আমাদেরকে যখন মুজদালিফায় নেয়া হচ্ছিল তখন একটা বন্ধ গাড়ির ভেতরে রাখা হয়েছিলো, বাতাস চলাচলের মতো অবস্থাও ছিলো না। এরপর মুজদালিফা থেকে আমাদেরকে ৯ ঘণ্টার পথ  হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের প্রতিটা মানুষের চোখের পানি পড়ছে।

সাভারের হাজী হাফিজুর রহমান খান নাঈম বলেন, দ্য সিটি ট্রাভেল এজেন্সি মহিলা-শিশুসহ তাদের ৪৫ জনকে কি যে কষ্ট দিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে এ-ক্যাটাগরি, তিন লাখ টাকায় বি-ক্যাটাগরি ও ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় সি-ক্যাটাগরির (থাকা-খাওয়া) সুবিধা দেয়ার কথা থাকলেও সব হাজীকে একই হোটেলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখে এই এজেন্সির মালিক নুর মোহাম্মদ।

হাজী হাফিজুর রহমান খান নাঈম জানান, বাংলাদেশ দূতাবাস ও মক্কা হজ অফিসে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

একজন হাজী জানান, অত্যন্ত ছোট একটি কক্ষে ৪-৫ জনকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। খাওয়ার পানি ছিলো না. বাথরুমে টিস্যু ছিলো না। রুমের ভেতর দুর্গন্ধ। পলিথিনে দেওয়া হয় খাবার। অনেক সময় পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাসার ওয়াশরুমে ওজু করতে হলে সিরিয়াল ধরার কারণে মসজিদে জামাতে নামাজ ধরা যেতো না। হাজী সেকেন্দার আলী সরদার জানান, হাজিদেরকে ফ্রিজে রাখা অনেক পুরোনো খাবার দেওয়া হয়েছে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই।

বেসরকারি ব্যবস্থাপনার মতোই সরকারি ব্যবস্থাপনায় যারা হজে গিয়েছেন তাদের দুর্ভোগও ভয়াবহ। এ বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ৪ হাজার ১৯৮ জন সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করতে সৌদি আরবে যান।

গতকাল শনিবার দেশে ফিরে বিমানবন্দরে দিনাজপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোকারম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, একটা রুমে ১২০ জনকে রাখা হয় শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে। খাবার দিয়েছে ঝাল-নুন ছাড়া সেদ্ধ করা মাংস, পাতলা ডাল আর ভাত। আরাফা থেকে মুজদালিফা তিন ঘণ্টার পথ হাটিয়ে নিয়েছে আমাদের। গাড়ী দেয়নি। তিনি বলেন, সরকারী ব্যবস্থাপনায় কেউ হজে যাবেন না। এতো অব্যাবস্থাপনা যে কল্পনাও করা যাবে না। অথচ পার্শ্ববর্তী ভারত এবং পাকিস্তান থেকেও সরকারি ব্যবস্থাপনায় অনেকেই হজে যান। আমরা দেখেছি তাদের প্রতি কত যত্ন নেয়া হয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের হাজিরা সৌদি আরবে যেমন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন তার ছিটেফোঁটাও পাননি বাংলাদেশিরা।

সরকারী ব্যবস্থাপনায় হজ থেকে গতকাল ফিরে আসা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনিস ফিরোজাও একই রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল (জেদ্দার হজ কাউন্সিলর) মাকসুদুর রহমান বলেন, অনেক অভিযোগ পেয়েছি, একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব তদন্ত করছেন। আমরা নিজেরাও খতিয়ে দেখছি। এ ব্যাপারে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি বজলুল হক হারুন বলেন, আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি। সৌদি আরবে কিছু এজেন্সি হাজীদের সাথে যে আচরন করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। দায়ী সকল এজেন্সির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

সরকারী তথ্য মতে গতকাল সকাল পর্যন্ত বিমান ও সৌদিয়া এয়ারলাইন্সে মোট ১১ হাজার ৯৩৩ জন হাজী দেশে ফিরেছেন। ফিরতি ফ্লাইট সংখ্যা ৩০ টি । বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পরিচালিত ১৩ টি; সৌদি এয়ারলাইন্স পরিচালিত ১৭ টি। আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে ফিরতি ফ্লাইট। চলতি মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে মোট ১ লাখ সাতাশ হাজার ২২৯ জন হজ পালন করেছেন। ইত্তেফাক

পাঠকের মতামত: