ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

ভালবাসার অমর নিদর্শন “মাথিনের কূপ”

sumanআহসান সুমন:
লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ আর মমতাজের প্রতি স¤্রাট শাহজাহানের অমর প্রেম কাহিনীর মতো পৃথিবীতে ভালবাসাবাসি মানুষদের বিয়োগান্তিক বহু বিরল ঘটনা রয়েছে। যা এখনো প্রজন্মের কাছে কালের সাক্ষি। তেমনি এক বিরল অমর প্রেমগাঁথা “মাথিনের কূপ”। যে কূপটির অবস্থান দেশের সর্ব দক্ষিনের সীমান্ত জনপদ কক্সবাজারের টেকনাফে।

শত বছর আগের কথা। ধীরাজ ভট্টাচার্য নামে সুদর্শন এক পুলিশ কর্মকর্তা বদলী হয়ে আসেন টেকনাফ থানায়। তৎকালিন সময়ে এলাকাটির অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা কারনে অনেকটা দুর্গম ও ভয়ংকর জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিলে এলাকাটি।

পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ যেহেতু সু-দুর কলকাতা থেকে চাকরী করতে এসেছেন সে জন্যে তাকে আত্মীয় স্বজনহীন খুবই একাকী সময় কাটাতে হতো।

ধীরাজ বাবু তার কাজের ফাঁকে প্রায় সময় থানার বারান্দায় আনমনা হয়ে চেয়ারে বসে থাকতেন। স্থানীয়দের জনশ্রুতি ও এলাকার প্রবীন লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, পুরো টেকনাফ জুড়ে একমাত্র পাতকুয়া ছিলো থানা কম্পাউন্ডের কুয়াটি।

বিশাল এই কূপে পানি নিতে আসতো স্থানীয় মগ সম্প্রদায়ের সুন্দরী তরুণীরা। রং বেরংয়ের আকর্ষনীয় পোষাক পড়ে পাতকুয়া থেকে কলসী হাতে পানি নিতে আসা এসব সুন্দরী যুবতীর মৃদু কন্ঠে ভেসে আসা সুরলা মধুর গান শুনে মুগ্ধ হন থানার অফিসার ইনচার্জ ধীরাজ। শুধু তাই নয়, সেখানে ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী সুন্দরী তরুণীরা বেশ ভালই আড্ডা জমাতো।

যাদের মধ্যে খুব আকর্ষনীয় ছিলো স্থানীয় মগ জমিদার ওয়ানথিন এর একমাত্র রূপবতী কন্যা মাথিন।

আর সেই মাথিনকে দেখে মনে মনে ভালবেসে ফেলে প্রেমিক ধীরাজ। এরপর থেকে প্রতিদিন সকালে থানার বারান্দায় বসে মাথিনের আসা-যাওয়া দেখার এক ফাঁকে দু’জনার মাঝে ঘটে যায় হ্নদয় দেয়া নেয়ার ঘটনা।

সম্ভব অসম্ভব নানা জল্পনা-কল্পনার স্বপ্নজালে আবদ্ধ হয় ধীরাজ ও মাথিন। কিন্তু মন দেয়া নেয়ার কিছুদিন যেতে না যেতেই কলকাতা থেকে হঠাৎ একদিন ধীরাজের কাছে ব্রাহ্মন পিতার জরুরী টেলিবার্তা আসে। যেখানে তার বাবা লিখেছেন-খুব জরুরীভাবে এক মাসের ছুটি নিয়ে তাকে কলকাতা যেতে হবে। এমনকি ছুটি না মিললে চাকরি এস্তেফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। বাবার টেলিগ্রাম পেয়ে টেকনাফ থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন পুলিশ অফিসার ধীরাজ। যদিও মাথিন কোনভাবেই ধীরাজকে যেতে দিতে চাননি। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে এক সন্ধ্যায় গোপনে টেকনাফ ছেড়ে পালিয়ে যান পুলিশ অফিসার ধীরাজ। সেই থেকে প্রিয়তম মানুষটির হঠাৎ প্রস্থানকে সহজভাবে মেনে নিতে পরেননি জমিদার কন্যা প্রেমিকা। এরিমধ্যে দিন, মাস, বছর যায় ফিরে আসেনা মাথিনের সখা প্রাণের ধীরাজ। এদিকে ভালবাসার প্রিয় মানুষটি ফিরে না আসায় অনাহার-অনিদ্রায় দিন গুনতে থাকে জমিদার কন্যা মাথিন। বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় মাথিন এক সময় অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

বিষাদের কষ্ট এবং বেদনা-বিধুর প্রেমের উপাখ্যানের বহুল আলোচিত সেই ঘটনার কালজয়ী সাক্ষী আজকের ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ।

যা এখনো আকর্ষনীয় হয়ে আছে সীমান্ত উপজেলার টেকনাফ থানা কপাউন্ডে। সেই থেকে পাতকুয়াটির নামকরণ হয় অমর প্রেমের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক “মাথিনের কূপ”।

অন্যদিকে ধীরাজ ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত জীবনী নিয়ে লেখা “যখন পুলিশ ছিলাম” গ্রন্থে তারই ভালবাসার স্মৃতি আদরিনী মাথিনের কথা লিখেছেন বেশ স্বযত্নে।

১৯৩০ সালের পহেলা আষাড় লাহোরের ওবাইদুল্লাহ রোডের জিলানী ইউনিক প্রেস থেকে বইটি প্রকাশিত হয়।

ওই বইয়ের বিখ্যাত চরিত্রে মাথিনের কূপ সংশ্লিষ্ট কাহিনীটি রচিত রয়েছে। তবে ভালবাসার জন্য রাখাইন জমিদার কন্যা মাথিনের এই জীবন বিসর্জন কাহিনী কোনভাবেই মানতে রাজি নন টেকনাফের রাখাইনরা। তাদের দাবী, মাথিন কূপের এই প্রেমকাহিনী সাহিত্যিক পুলিশ অফিসার ধীরাজের লেখা উপন্যাসের কল্পিত চরিত্রের ইতিহাস মাত্র।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, অমর প্রেমের বেদনা বিধুর এই ইতিহাস জানতে প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় ৮ লাখ পর্যটক টেকনাফের ঐতিহাসিক এই মাথিনের কূপ দেখতে আসেন। আর এ কূপকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে পর্যটক নির্ভর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও।

প্রসঙ্গত: ১৯৮৪ সালের ২৪ এপ্রিল প্রথম টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডে মাথিনের কুপের ইতিহাস সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড ঝুলানোর উদ্যোগ নেন প্রথম আলো পত্রিকার কক্সবাজার অফিস প্রধান সিনিয়র সাংবাদিক আবদুল কুদ্দুস রানা।

এরপর ২০০৮ সালের দিকে প্রায় ২৬ লাখ টাকা ব্যায়ে মাথিনের কূপটি আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নেন কক্সবাজারের তৎকালিন পুলিশ সুপার বনজ কুমার মজুমদার (বর্তমান ডিআইজি)।

পরবর্তীতে ২০১২ সালের ৪ মার্চ তৎকালিন পুলিশ সুপার সেলিম মোঃ জাহাঙ্গীর পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্যের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেন।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড.কেএম ইকবাল হোসেন জানান, পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজের অমর প্রেম কাহিনী ও তার স্মৃতি বিজড়িত এই কূপটির সৌন্দর্য্য রক্ষার্থে টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডকে প্রশাসনিকভাবে সবসময় নজরদারীতে রাখা হয়। কারন এটি ঐতিহাসিক ও অমর ভালবাসার অনন্য এক নিদর্শন।

লেখক : আহসান সুমন
বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আজকের কক্সবাজার।
জেলা প্রতিনিধি, এসএ টিভি।
ফোন : ০১৮১৮-১৩১৩৩৭

পাঠকের মতামত: