মহেশখালীর মাতারবাড়িতে সাগরপারে বেড়িবাঁধ ও সড়ক নির্মাণকাজ চলছে জোরেশোরে (বামে)। পেকুয়ার করিয়ারদিয়ায় লবণ ও চিংড়িঘেরের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য
সাগরতীরে জাল ফেলে মাছ ধরে জেলে। মশারি জালে আহরণ করা হয় চিংড়িপোনা। মাঠে লবণচাষি উত্পাদন করে লবণ। এর পর একই মাঠে হয় চিংড়িচাষ। জেলেপাড়ায় ঘরের আঙিনায় চলে মাছ শুকানোর ধুম। সাগরপারের লণ্ডভণ্ড বেড়িবাঁধ দিয়ে ঢুকে জোয়ারের পানি। হরহামেশা দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় উপকূলবাসীকে। সাম্প্রতিককালে উন্নয়নযজ্ঞে মহেশখালী উপকূলের চিরাচরিত এমন দৃশ্য বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। লিখেছেন : তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার
শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় হাতে কোদাল আর মাথায় ঝুড়ি নিয়ে মাটি কেটে উপকূল রক্ষায় বাঁধ দিয়ে আসছে উপকূলবাসী। এখন সেই বেড়িবাঁধ নির্মাণে স্থান করে নিয়েছে শক্তিশালী স্কেভেটর, বুলডোজার আর ড্রেজার। নির্মাণকাজে আনা হয়েছে ভারী ড্রাম ট্রাক। ১০ মে কক্সবাজারের মহেশখালী, মাতারবাড়ি ও করিয়ারদিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এ দৃশ্য।
মাতারবাড়ির কুহেলিয়া খালের মোহনায় নোঙর করেছে চারতলাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক বার্জ। এই বার্জে রয়েছেন বিদেশি প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বার্জটির নিরাপত্তায় রয়েছে তিনস্তরের ব্যবস্থা। মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক এক নম্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে দ্রুতগতিতে।
উঁচু বেড়িবাঁধ, রাস্তা ও সেতু নির্মাণ হচ্ছে সমানে। প্রকল্পের জমি ভরাট করা হচ্ছে ২৫/৩০ ফুট উঁচু করে। মাতারবাড়ির জাইকা প্রকল্পের সাথেই হচ্ছে একটি গভীর সমুদ্রবন্দরও। ওই প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৪১৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়েছে ২৩৭ কোটি টাকা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এখানে বিদ্যুৎ উত্পাদন হবে ১৩২০ মেগাওয়াট।
সাগরপারের লবণমাঠে বৃহত্তর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণযজ্ঞ দেখে মাতারবাড়ির সাইরার ডেইল গ্রামের বাসিন্দা আবদুল ছমদ (৮০) বলেন, ‘অ বাজিরে সারাজীবন এডে দেক্কিদে নৌকা আর সাম্পান। কানে ফুন্নিদে দরিয়ার গর্জন। আর এহন দেখিদ্দে ডর ডর ভুটভুইট্যা গাড়ি। গাড়ির গর্জনে এহন আর দরিয়ার গর্জনও ফুনা ন যায়। ’ মগডেইল গ্রামের বৃদ্ধ আকবর আলী বলেন, ‘আঁরা জীবনভর এডে চেরাগ বাত্তি জ্বাল্লিদে। এবার বিদ্যুৎ বাত্তি জ্বাইল্লুম। শেখর মাইয়া (প্রধানমন্ত্রী) আঁরারে আরো কি দেহাইব হইত ন পারির। দেশ আগাই যার বাজিরে। ’
তিন একর জমিতে লবণ ও চিংড়িচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন সিরাজুল মোস্তফা (৫১)। তাঁর সেই জমি অধিগ্রহণের তালিকাভুক্ত। নিজের বসতভিটাও অধিগ্রহণের তালিকাভুক্ত। তবু কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার সিরাজুল মোস্তফা গর্ব করে বলেন, ‘আমি দেশ-জাতির উন্নয়নের অংশীদার। আমার জমিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। সেই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে। দেশ আলোকিত হবে। ’
১৯৯১ সালের ভয়াল ২৯ এপ্রিলের শতাব্দির প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মরণ থাবা থেকে বেঁচে যান সিরাজুল মোস্তফা। সেই রাতে তাঁর পরিবারের ৮৮ সদস্য প্রাণ হারান। পেকুয়ার উজানটিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড করিয়ারদিয়ার বাসিন্দা তিনি। টানা তিনবার ইউপি মেম্বার ছিলেন। মহেশখালী চ্যানেলের তীরে ওয়ার্ডটির ১৪০০ লোক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারান ওই রাতে। জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছিল করিয়ারদিয়ার লবণ ও চিংড়িঘেরসহ উপকূলীয় জনপদ।
মহেশখালী দ্বীপে পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের করিয়ারদিয়ার এলাকার অবস্থান। প্রায় দুই হাজার ভোটারের এই ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের পেশা লবণ ও চিংড়িচাষ। এখানে ১৮০০ একর জমির ২৬টি লবণ ও চিংড়িঘের রয়েছে। এর মধ্যে ১৩৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে মহেশখালী চতুর্থ তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য। এছাড়া একটি চিংড়ি ও লবণঘের নিয়ে রয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১২০০ একর জমি। করিয়ারদিয়ার এসব জমি অধিগ্রহণ হলে সেখানকার দুই শতাধিক পরিবারের বসতঘরও উচ্ছেদ হবে। কিন্তু তাঁদের পুনর্বাসনের কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এলাকাবাসীর মাঝে চরম হতাশা নেমে এসেছে।
করিয়ারদিয়া ঘুরে জানা গেছে, প্রতিমৌসুমে এসব জমিতে কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকার লবণ উত্পাদন হয়। সেই সাথে চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ উত্পাদন হয় প্রায় ১৫০ কোটি টাকার। অর্থাৎ এক বছরে ওই বিশাল ঘেরে লবণ ও মাছ উত্পাদন হয় কমপক্ষে ১৭৫ কোটি টাকার। আর অধিগ্রহণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে মাত্র ২৩০ কোটি টাকার বিনিময়ে। জমির অংশীদার অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, এক বছরের উত্পাদনের টাকা দিয়েই চিরদিনের জন্য ১২০০ একরের জমি অধিগ্রহণ করার প্রস্তাবে অংশীদারদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। তাঁরা এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সারাদেশের মধ্যে কক্সবাজারেই সরকারের মেগা প্রকল্পের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ফলে কক্সবাজারে জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। তাই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও বেশি। ইতিমধ্যে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে জাইকা প্রকল্পের ১৪১৪ একর এবং সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ প্রকল্পের ১২০০ একর জমি অধিগ্রহণপূর্বক দেড়গুণ করে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার কাজ চলছে। জাইকা প্রকল্পের শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মাতারবাড়ির দ্বিতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র সিঙ্গাপুর প্রকল্পের শতকরা ৩০ ভাগ ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে, মহেশখালীর হোয়ানক, হেতালিয়া, কালারমারছড়া, অমাবশ্যাখালী, পানিরছড়া ও হরিয়ারছড়া মৌজায় এলএনজি ও কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৫৬৪৬ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। পেকুয়ায় নৌবাহিনীর সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণের জন্য ৪১৯ একর জমি, মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্পসহ আরো কয়েকটি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। সেই সাথে রামুতে বিকেএসপি প্রকল্পের জন্যও জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়া বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যও ২৪ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।
ইতিমধ্যে মন্ত্রিসভায় অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের দেড়গুণ থেকে বাড়িয়ে তিনগুণ ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। এর পর থেকে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন জমির মালিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ তিনগুণ ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন। আবার অধিগ্রহণের নোটিশ পেয়ে অনেকে হতাশও।
গত ৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কক্সবাজার সফরকালে বিমানবন্দর প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণের তিনগুণ টাকা পেতে আবেদন জানিয়েছেন। তাঁদের আশা, বিষয়টি কোনো রকমে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে নিতে পারলেই ক্ষতিগ্রস্তদের কপাল খুলে যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্তটি এখনো গেজেট আকারে প্রকাশ হয়নি। তার আগেই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাচ্ছে।
চলমান এই প্রক্রিয়ায় দেড়গুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে।
অধিগ্রহণ করা জমির তিনগুণ ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানের বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন। তবে অধিগ্রহণ করা জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া লোকজনদের পুনর্বাসনে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রত্যাশী সংস্থার পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
উল্লেখ্য, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের এক সভায় জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের টাকা তিনগুণ প্রদানের সিদ্ধান্তটি অনুমোদন করা হয়। এতে বলা হয়, দেশে জায়গা-জমির মূল্য বেড়ে গেছে। সরকারি প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা সম্পত্তির মালিক জমির মালিকানা হারাচ্ছেন চিরতরে। এমন ব্যক্তিও রয়েছেন যার সর্বশেষ সম্বলটুকুও হারাচ্ছেন। সিদ্ধান্ত কেবল মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে। এখনো গেজেট না হওয়ায় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ।
ক্ষতিগ্রস্তরা মনে করেন, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তটি যেদিন নেওয়া হয় সেদিনই গেজেট প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত আগের দেড়গুণ ক্ষতিপূরণের চলমান নিয়ম স্থগিত রাখলে তাঁরা লাভবান হতেন।
এদিকে, তিনগুণ ক্ষতিপূরণের টাকার দাবিতে প্রকল্পের অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় থাকা জমির ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারের কাছে আবেদন করার পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে নেমেছেন। ইতিমধ্যে রামুতে বিকেএসপির জন্য বাছাই করা জমির মালিকরা মানববন্ধন করেছেন। সংবাদ সম্মেলন করেছেন পেকুয়ার করিয়ারদিয়া মৌজার ১২০০ একর জমির মালিকরা। তাঁদের আশঙ্কা, অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণ তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়িত না হলে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করতে পারে। কালের কণ্ঠ
পাঠকের মতামত: