প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ৭১২টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় ৪ জেলায় ১০ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।
নির্বাচনের দিন গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই বিভিন্ন ইউনিয়নে ব্যাপক অনিয়ম, সহিংসতার অভিযোগ যেমন এসেছে, পাশাপাশি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ কেন্দ্রগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণের খবরও মিলেছে। আবার অনিয়মের অভিযোগে অনেক কেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল।
নির্বাচনের মূল্যায়নে স্থানীয় সরকার গবেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, ‘দলীয় ব্যানারে নির্বাচন হওয়ায় বিশৃঙ্খলাকারীরা আরও বেশি প্রশ্রয় পেয়েছে। আর বিরোধী দল মাঠ ছেড়ে দেওয়ায় নিজেদের মধ্যেই বেশির ভাগ সংঘর্ষ হয়েছে। আলাপ-আলোচনা না করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা এখনো বন্ধ করা যেতে পারে।’
বিভিন্ন জেলায় সহিংসতায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীরা বিদ্রোহী প্রার্থীদের ওপর যেমন হামলা করেছেন, তেমনি বিদ্রোহী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগের প্রচারণায় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বিভিন্ন জেলার আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জড়িয়েছেন বাগযুদ্ধে। নির্বাচনের আগে প্রিসাইডিং অফিসারের ওপর হামলা হয়েছে, কোথাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে ব্যালট পেপার। কোনো কোনো কেন্দ্রে দুর্বৃত্তরা ত্রাস সৃষ্টি করতে হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘নির্বাচন হলো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া, এটা সভ্য প্রক্রিয়া। তার বিপরীতে সামন্তবাদী যুগে যার জোর আছে, সেই ক্ষমতায় বসবে এবং শাসনকার্য পরিচালনা করবে। সেই পদ্ধতি থেকে আমরা যে সভ্য প্রক্রিয়ায় আসলাম, এখন তো সহিংসতা ঘটছে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে। বিএনপি যদি কোমর ভাঙা না হতো তাহলে সহিংসতা বেসামাল পর্যায়ের হতো না। মনোনয়ন বাণিজ্য, মনোনয়ন প্রদান ও ভোট দেওয়াতে বাধা―সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব, তারা দায় নেবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহযোগিতা করছে না। দায় তাহলে নেবে কে? আমরাও তো অসহায়। তারা তো শপথ গ্রহণ করেছে। পুরো বিষয়টা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়াটা ভেঙে পড়ছে। নির্বাচনের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। নির্বাচনের প্রতি যখন মানুষের আস্থা চলে যায়, তখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকে না। নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুরু হয়। এটা আমাদের চরম সঙ্কটের দিকে নিয়ে যাবে। ক্ষমতাসীন দল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে। সহিংসতা ঘটছে তাদের (ক্ষমতাসীন) নিজেদের মধ্যে। সামাজিক সম্প্রীতি যেভাবে নষ্ট হলো এটা শঙ্কিত হওয়ার কারণ।’
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এবারের প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে নব্বইয়ের দশক ও ২০১১ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তাহলে দেখা যায়, এবারের নির্বাচন সাংঘাতিক রকমের প্রশ্নবিদ্ধ। এটার কারণ, ব্যাপক হারে কেন্দ্র দখল, সন্ত্রাস, জাল ভোট, মারামারি যা পূর্বেকার সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সামনে আরও দুই ধাপ রয়েছে। এভাবে চললে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘দলীয় ব্যানারে নির্বাচন হওয়ায় বিশৃঙ্খলাকারীরা আরও বেশি প্রশ্রয় পেয়েছে। আর বিরোধী দল মাঠ ছেড়ে দেওয়ায় নিজেদের মধ্যেই বেশির ভাগ সংঘর্ষ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতেও বেশ কয়েকজন নিহত হলো। অতীতের কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এত সহিংসতা হয়নি। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে বা তাদের সুযোগ দেওয়া হলে এমনটিই হয়।’
স্থানীয় সরকারের এই গবেষক আরও বলেন, ‘এভাবে দেশ চলতে পারে না। রাজনীতিক দল, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে আলোচনা সাপেক্ষে ঐকমত্যে আসতে হবে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে। স্থানীয় পর্যায়ের মানুষের কাজ ও মতামতকে সব দলেরই সম্মান দিতে হবে। সব দখল করতে হবে এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে, সংবেদনশীল হতে হবে। সবকিছুই দলীয়ভাবে এই চিন্তা-চেতনা বাদ না দিলে আরও ভয়াবহতা দেখা দিতে পারে। সব পক্ষই এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের নির্বাচনগুলো সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে কাজ করবেন বলে আশা রাখি।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মো. হাফিজ উদ্দিন খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এবারের নির্বাচন সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনের মতোই চুপেচাপে অনিয়ম করা হয়েছে। আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মারা, গণহারে জাল ভোট দেওয়া, প্রতিপক্ষ নির্বাচনী এজেন্টদের বের করে দেওয়া, হামলা করা, ভোটদানে বাধা সবই হয়েছে। আর নির্বাচনের আগেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে মনোনয়নপত্র বিরোধীরা জমা না দিতে পারে। যাতে করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। আর প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা স্বাধীনতার পরে অনুষ্ঠিত সব স্থানীয় নির্বাচনের সীমা অতিক্রম করেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছিলাম, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না করতে। আমাদের কথা ও যুক্তি উপেক্ষা করে সরকার এটা করল। এখন কি ঘটল তা সবাই দেখছেন। সামনে আরও কত ভয়াবহতা আসে তা কে জানে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সরকারদলীয় লোকজনের হতাহতের ঘটনা সরকারকে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। বেশি দখলবাজি করলে কী হতে পারে তার একটা আগাম সংকেত এটা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আলাপ-আলোচনা না করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা এখনো বন্ধ করা যেতে পারে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত আগের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এবারেও। সেটা তাদের কথায়ও প্রমাণ হয়েছে। ইসি তো বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যে যাই বলুক, সবার আগে দরকার সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা। সেটা থাকলে সবাই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।’
দ্য রিপোর্ট
পাঠকের মতামত: