নিজস্ব প্রতিবেদন :: ভারী বর্ষণে ভূমিধসের শঙ্কায় আছে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত ৮৩৫টি পরিবার। টানা বর্ষণে এসব পাহাড়ে ধসের শঙ্কা রয়েছে যে কোনো মুহূর্তে। যদিও লোকজনকে সরে যেতে গতকাল দিনভর মাইকিং করছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। কিন্তু তাতে খুব একটা সাড়া দেননি ‘মৃত্যুঝুঁকি’তে থাকা বসবাসকারীরা।
২০০৭ সালের ১১ জুন ভয়াবহ পাহাড় ধসে ১২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। জেলা প্রশাসন প্রতিবছর আগাম উচ্ছেদ অভিযানও পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু এবার মহামারি করোনাভাইরাসের চাপে ভাটা পড়ে উচ্ছেদ কার্যক্রমে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে থেকেই যায় লোকজন। পতেঙ্গা ভূমি অফিসের সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, আবহাওয়া অধিদপ্তরে বার্তায় ভারী বর্ষণের পাহাড়ধসের আশংকা থাকায় সকাল থেকেই নগরীর ৬টি সার্কেলের অধীনে থাকা পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণদের সরাতে মাইকিং করা হচ্ছে। নগরীর চান্দগাঁও, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ ও কাট্টলী এলাকায় ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে যে কেউ আশ্রয় নিতে পারবেন। বুধবার সকাল থেকে নগরীর সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত লোকজনকে সচেতন করতে মাইকিং করেছে জেলা প্রশাসন। এসব পাহাড়ের সরিয়ে নিতে ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং সরকারি সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন পাহাড়গুলোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে ২৮টি পাহাড়ের মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে ১৭টি। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটিতে ৩০৪ পরিবার এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০ পাহাড়ে ৫৩১টি পরিবার বাস করছে। সরকারি পাহাড়গুলোর মালিক হলো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, রেলওয়ে, ওয়াসা এবং গণপূর্ত ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।
১৭ পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধভাবে বসবাস করা ৮৩৫ পরিবারের মধ্যে রেলওয়ের লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২২ পরিবার, পূর্ব ফিরোজ শাহ এক নাম্বার ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮ পরিবার, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মালিনাকানাধীন কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনি পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশন পাহাড়ে ১০ পরিবার, রেলওয়ে, সওজ, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ে ১৬২ পরিবার, ব্যক্তি মালিকানাধীন একে খান পাহাড়ে ২৬ পরিবার, হারুন খানের পাহাড়ে ৩৩ পরিবার, পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩ পরিবার, মধুশাহ পাহাড়ে ৩৪ পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩ পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৩২ পরিবার, আকবর শাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮ পরিবার, আামিন কলোনি সংলগ্ন ট্যাংকির পাহাড়ে ১৬ পরিবার, লালখান বাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ১১ পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১ পরিবার, ফয়েজলেক আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ৯ পরিবার এবং এম আর সিদ্দিকী পাহাড়ে আটটি পরিবার বসবাস করছে।
১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত : আশ্রয়কেন্দ্রগুলো হলো, পাহাড়তলি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বিশ্ব কলোনির কৈবল্যধাম কোয়াড পি ব্লক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফিরোজ শাহ হাউজিং এস্টেট এলাকার ফিরোজ শাহ কলোনি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফিরোজ শাহ হাউজিং এস্টেট এইচ ব্লকে বায়তুল ফালাহ আদর্শ মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, জালালাবাদ বাজার সংলগ্ন শেড, রউফাবাদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, রশিদিয়া রউফাবাদ আলিম মাদ্রাসা, মহানগর পাবলিক স্কুল, আলহেরা মাদ্রাসা, আমিন জুট মিল ওয়ার্কার্স ক্লাব, আমিন জুট মিলস নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, লালখানবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এবাদ উল্লাহ পন্ডিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শহীদ নগর সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কলিম উল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ওয়াই ডব্লিউসিএ কার্যালয়, শেখ রাসেল প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মতিঝর্ণা ইউসেফ স্কুল।
পানি জমেনি নিচু এলাকায় : জলাবদ্ধতা চট্টগ্রাম নগরীর অভিশাপ হলেও বুধবার দিনভর টানা বৃষ্টিতেও নগরীর উল্লেখযোগ্য এলাকাগুলোতে পানি জমেনি। কিছু নিচু এলাকায় পানি উঠলেও তা স্থায়ী হয়নি। বুধবার দিনভর বৃষ্টিতে নগরীর কিছু নিচু এলাকায় পানি জমতে দেখা গেলেও বেশিরভাগ এলাকা থেকে পানি নেমেছে দ্রুত। অন্য সময়ে জোয়ারের কারণেও নগরীর আগ্রাবাদ সিডিএ, চাক্তাই এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হলেও বুধবার বৃষ্টিতে ওইসব এলাকায় পানি জমেনি। তবে সিটি কর্পোরেশন বলছে, প্রাথমিক পর্যায়ের নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুতই নেমে যাচ্ছে। এতে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমদ চকরিয়া নিউজকে বলেন, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি যেসব নালা-নর্দমা আমাদের এখতেয়ারে আছে সেগুলো আমরা শতভাগ পরিষ্কার করেছি। যেগুলোতে কাজ চলমান আছে সেখানে অন্তত মাটি তুলে তা নালা-নর্দমার পাড়ে ফেলে রাখিনি। ফেলে রাখলে অনেক সময় তা আবারো পড়ে গিয়ে ভরাট হয়ে যায়। তাছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সঙ্গে আমরা সমন্বয় করে কাজ করছি। তারাও কাজ করার জন্য যেসব খালের মুখে বাঁধ দিয়েছিল সেগুলো অপসারণ করেছে। ফলে পানি দ্রুত নেমে গেছে। এ প্রকৌশলী বলেন, বৃষ্টি হলে পানি জমবেই। তবে দেখতে হবে সেটা দ্রুত নেমে যাচ্ছে কী না। এখন কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পানি নেমে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিস বুধবার সন্ধ্যা ৬টার স্থানীয় পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের আকাশ মেঘলা থেকে মেঘাচ্ছন্ন থাকতে পারে। সে’সাথে সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা কিংবা ঝড়ো বাতাসের সাথে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি কিংবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধ্বসের আশংকা রয়েছে।
তাছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তসংলগ্ন এলাকায় গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালা তৈরি হচ্ছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্ব দিক হতে ঘণ্টায় ১০-১২ কি. মি. বেগে, যা অস্থায়ীভাবে দমকা কিংবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৩০-৪০ কি. মি. বেগে পর্যন্ত প্রবাহিত হতে পারে।
পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। বুধবার বিকাল ৩ টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৭৮ মি.মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসে। বুধবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৭.৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ২৫.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তাছাড়া চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের জন্য ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত এবং চট্টগ্রাম নদী বন্দরের জন্য ১নং সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
পাঠকের মতামত: