ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

চালের মূল্যবৃদ্ধিতে খাতুনগঞ্জের চার ব্যবসায়ীর চালবাজি

Rice-14-09-17-289x525অনলাইন ডেস্ক ::

চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের চার আমদানিকারকের চালবাজিতে অস্থির হয়ে ওঠেছে চট্টগ্রামের চালের বাজার। আমদানি করা চাল গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। মর্জিমাফিক দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই সি–িকেট। গত ৭ দিনের ব্যবধানে সব ধরনের চাল কেজিতে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
তবে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের দাবি, আন্তর্জাতিক বুকিং দর বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় বাজারে প্রভাব পড়েছে। বাজার অস্থিরতার জন্য সিন্ডিকেট কারসাজি বলে দায়ী করেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন। বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছে ক্যাব।
একাধিক সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার শীর্ষ আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী নেতাদের ডেকে সতর্ক–হুঁশিয়ারি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
গত বৃহস্পতিবার চালের বড় পাইকারি বাজার চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলী ঘুরে অন্তত ১৫ জন ব্যবসায়ী–ব্যবসায়ী নেতা এবং মিল মালিকদের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, শীর্ষ চার আমদানিকারকের কারসাজিতে বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। মূলত চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন চিনি তেল ও গম ব্যবসায়ীরা। সরকার চালের শুল্ককর কমানোর পর চার শীর্ষ ব্যবসায়ীসহ মধ্যম সারির ৫–৬জন চাল ব্যবসায়ী ভারত মিয়ানমার ও থাইল্যা– থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসায়ী চাল গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। এখন ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে বাজারজাত করার অভিযোগ রয়েছে।
তবে দামবৃদ্ধির জন্য আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা কৌশলে একে অপরকে দুষে আসছেন। গুদামজাত ও কৃত্রিম সংকটের কথাও বলেছেন কয়েকজন ব্যবসায়ীরা।
পাইকারি ব্যবসায়ী ও চাল মিল মালিকেরা জানান, গত ২০ জুন চালের শুল্ককর ২৮ শতাংশ থেকে নামিয়ে ১০ শতাংশ এবং চাল আমদানিতে ব্যাংক ঋণের নানা সুবিধা ঘোষণার পর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বেড়েছে। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমতি ছিল। সেসময়ে বড় ব্যবসায়ী ছাড়াও মধ্যম সারির চাল ব্যবসায়ীরা প্রচুর পরিমাণে চাল আমদানি করেছেন। কিন্তু শীর্ষ ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকেরা আমদানি করা চাল বাজারে বিক্রি না করে অধিকাংশই গুদামজাত করেছেন। এখন দাম বাড়ার পর ক্রমান্বয়ে তা বাজারজাত করছেন।
চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি শান্ত দাশগুপ্ত গতকাল দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, জুনের শেষ সপ্তাহ ও জুলাই মাসে আমদানি করা চালের আন্তর্জাতিক বাজার দর ৩৬০ ডলার ছিল। কেজিতে ২৮–২৯ টাকা। সেই চাল গুদামজাত করে এখন ৪৫–৪৬ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। সরকারের তদারকির অভাবে তা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলী পাইকারি বাজারে গত এক সপ্তাহে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৬ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গত শুক্রবার থেকে হু হু করে প্রতিদিন চালের দাম বেড়েছে।
গত শুক্রবার আমদানি করা ভারতীয় স্বর্ণাসিদ্ধ বিক্রি হয়েছে কেজিতে ৪১ টাকা দরে। সোমবার এসে তা বিক্রি হয়েছে ৪৪ টাকায়। পরদিন মঙ্গলবার আরও দুই টাকা বেড়ে ৪৬ টাকা এবং বৃহস্পতিবার সাড়ে ৪৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একইভাবে ভারতীয় আতপ শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ৩৫–৩৬ টাকা দরে। দুই দিনের ব্যবধানে সোমবার তা ৪০ টাকায় ঠেকে। মিয়ানমারের আতপ চাল কোরবানি ঈদের আগে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কোরবানের পর তা ৩২ টাকায় ঠেকে। বর্তমানে তা ৩৫–৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি বেতি–২৮ গত শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা দরে। প্রতিদিন এক টাকা করে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা দরে। ইরি মোটা গত শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ৩৩ টাকায়। তিন দফায় বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৬ টাকা দরে। এই চিত্রে দেখা যায় চালের দাম প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে।
চাল আমদানিকারক মো. ইদ্রিস মিয়া জানান, ভারত ও মিয়ানমারে চালের বুকিং রেট বৃদ্ধির কারণে দেশীয় বাজারেও দাম বাড়ছে। তিনি দাবি করেন, বিশ্ববাজারে বুকিং রেট ৩৭৫ ডলার থেকে বেড়ে ৪৫০ ডলার করা হয়েছে। এরসঙ্গে সড়কপথে দীর্ঘ যানজটের কারণে পরিবহন খরচও আগের চেয়ে বেড়েছে।
১৭৩০ টাকা বিক্রি করা বেতি চাল এখন ২২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যেসব ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের চাল মজুত ছিল, সুযোগ পেয়ে তারাও দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমরা আমদানিকারকেরা লাভ করতে পারিনি দোকানদাররা লাভ করে ফেলছেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চালের দাম যখন বাড়তি, তখন স্বাভাবিকভাবে আমদানিকারক, মিল মালিক ও দোকানদার মজুত করে রাখবে। দাম বাড়ার পর তা বিক্রি করবে।’ আমদানিকারকদের মধ্যে আগে যারা গুদামজাত করেছেন, তারা এখন বেশি লাভ পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন এই আমদানিকারক।
চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. এনামুল হক এনাম ও সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম জানান, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চালের বুকিং দর বাড়ার কারণে দেশীয় বাজারেও চালের দাম বাড়ছে।’
পাহাড়তলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মো. জাফর বলেন, বেনাপোল, সোনা মসজিদ, হিলিসহ কয়েকটি স্থল বন্দরে ভারত থেকে আমদানি করা প্রচুর চাল রয়েছে। কিন্তু এসব চাল চট্টগ্রামে আসতে দৌলতিয়া–মাওয়া ফেরি ঘাটে দীর্ঘ জটে পড়ে ৫–৬ দিন লেগে যাচ্ছে। ট্রাক ভাড়াও আগের তুলনায় দ্বিগুণ গুণতে হচ্ছে। এসব কারণে দাম বাড়ছে। এছাড়াও উত্তরবঙ্গের ৮–১০ চাল মিল ধান–চাল মজুদ করে রাখায় বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সরকার বাজার মনিটরিং ও ফেরিঘাটে বিকল্প ব্যবস্থায় চাল পারাপারের উদ্যোগ নিলে বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হবে।
ভোক্তা সংগঠন কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘আমদানিকারক সিন্ডিকেট ও বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে চালের দাম বাড়ছে। খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নজরদারি–মনিটরিং না থাকায় ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
চালের বাজার স্থিতিশীল করতে সরকার চাল আমদানির শুল্ক কর ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করেছে। শুল্ক কমানোর পরও কমছে না চালের দাম। উল্টো চালের দাম বেড়েই চলছে। অথচ ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, শুল্ক কমলে চালের দাম কমবে। সরকার গত এক মাসের ব্যবধানে চালে আমদানি শুল্ক মাত্র ২ শতাংশে নামিয়ে আনে। এর কোনো প্রভাব নেই বাজারে।
চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি শান্ত দাশগুপ্ত দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, চট্টগ্রামে চালের বাজার চিনি, তেল ও গম ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। এসব সিন্ডিকেট মৌসুমি পণ্য আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। সরকার বাজার মনিটরিং জোরদার না করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রামে কয়েকজন বড় মাপের ব্যবসায়ী এবং উত্তরবঙ্গের একাধিক সি–িকেটের কারসাজিতে চালের বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে।

পাঠকের মতামত: