ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

চট্টগ্রামে তরুণ আইনজীবী খুন

ট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার কে বি আমান আলী রোডের এক বাসা থেকে এক আইনজীবীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল শনিবার সকালে হাত–পা বাঁধা ও মুখে টেপ লাগানো অবস্থায় ওমর ফারুক বাপ্পী নামের উক্ত আইনজীবীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। চকবাজার থানার ওসি নুরুল হুদা আজাদীকে জানান, এসময় ওই বাসায় আর কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনদিন আগে এক নারী তার স্বামীসহ থাকবে জানিয়ে নিচতলার ওই বাসা ভাড়া নিয়েছিল। পরে সকালে বাড়ির দারোয়ান ঘরের ভেতরে লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। ওমর ফারুক বাপ্পী চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি বারে অন্তর্ভুক্ত হন। বাপ্পীর গ্রামের বাড়ি বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার চৌমুহনী এলাকায়। তাঁর বাবা আলী আহমেদ। মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বাপ্পী।

খুনের কারণ এক বা একাধিক? : ঘটনাস্থলে যাওয়া সিএমপির কোতয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) জাহাঙ্গীর আলম আজাদীকে বলেন, স্ত্রীর সাথে ঝামেলা, মামলা সংক্রান্ত বিরোধ এবং ব্যক্তিগত কিছু ঝামেলা খুনের নেপথ্যে কারণ হিসেবে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি বেশি। এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে। টার্গেট করে অভিযান চলছে। দেখা যাক, কত দ্রুত খুনীকে ধরতে পারি। এসি জাহাঙ্গির আরো বলেন, আমরা আইনজীবীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, কাগজে–কলমে বাপ্পী কাউকে বিয়ে করেছেন এমনটা পরিবার জানে না। যে বাসায় বাপ্পীর লাশ পাওয়া গেছে সেটি তার বাসা নয়। গতকাল (শুক্রবার) রাতে তাকে ওই বাসায় ঢুকতে দারোয়ান দেখেছে। খুনের জন্যই কি বাসা নেয়া? : বড় মিয়া মসজিদের সামনে ইউ ভবনটির দারোয়ান মো. ইলিয়াস আজাদীকে জানান, মঙ্গলবার বিকালে এক নারী বাসা ভাড়া নিতে আসেন। এসময় তার সাথে থাকা ছেলেটিকে তার ভাই বলে পরিচয় দেন। বাসায় তিনি স্বামী ও ছোটভাইকে নিয়ে থাকবেন বলে জানান। তার স্বামী চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী বলে পরিচয় দেন। বাসা পছন্দ করে অগ্রীম হিসেবে দুই হাজার টাকা দিয়ে যান। পরদিন সন্ধ্যায় দুইটি ভ্যানে করে কিছু বিছানাপত্র নিয়ে আসেন। জাতীয় পরিচয়পত্র চাইলে শনিবার দেবেন বলে জানান।

ইলিয়াস আরো জানান, শুক্রবার রাত আটটার দিকে আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীকে বাজারের ব্যাগ হাতে ঢুকতে দেখেন প্রতিবেশীরা। সকালে বাসার দরজা খোলা দেখে বাড়ির মালিককে ডেকে বিষয়টি জানান ইলিয়াস। বাড়ির মালিক এসে বাসার বাইরে থেকে দরোজায় কয়েকবার টোকা দেন। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয় নি। তারা তখন ভেতরে ঢুকে দেখেন হাত–পা বাধা অবস্থায় ঐ ব্যক্তির লাশ পড়ে আছে। বাসায় আর কেউ নেই।

দুজন মিলে খুন করে : ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক সন্তোষ চাকমা আজাদীকে বলেন, বাসা ভাড়া নেয়া ঐ নারী যে খুনের ঘটনায় জড়িত ছিল, তা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে তার সাথে এক পুরুষও ছিল। সে কি তার ভাই পরিচয় দেয়া ব্যক্তি, নাকি বাইরে থেকে আসা কেউ তা দেখা হচ্ছে। কারণ বাপ্পীর স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভালো। তাকে একজন কাবু করতে পারার কথা নয়। অন্ত:ত দুজন এ খুনের ঘটনায় অংশ নিয়েছে।

যেভাবে খুন করা হতে পারে : পিবিআই পরিদর্মক সন্তোষ কুমার চাকমা আজাদীকে বলেন, হতে পারে, তাকে প্রথমে খাওয়ার সাথে ঘুমের ওষুধ জাতীয় কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করা হয়েছে। তারপর হাত পা মুখ বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। পুরুষাঙ্গ কাটার কারণ কী হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা করা হতে পারে তীব্র আক্রোশ থেকে। শুক্রবার রাত সাড়ে আটটা থেকে শনিবার ভোরের মধ্যে কোনো এক সময় ওমর ফারুক বাপ্পী খুন হতে পারেন বলেও ধারণার কথা জানান সন্তোষ চাকমা।

বাপ্পীর জন্য কনে দেখা হচ্ছিল ! : নিহত বাপ্পীর বিয়ে সংক্রান্ত কোন সংবাদ জানেন না তার হতভাগ্য পিতা আলী আহমদ। তার পিতা জানালেন পরিবার থেকে বাপ্পীর জন্য কনে দেখা হচ্ছিল। সন্তানের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ভাই আবুল কালাম সহ ছুটে আসেন হাসপাতাল মর্গে। আলী আহমদ জানান, তাঁর তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় বাপ্পী। কুয়াইশ কলেজ থেকে বিএ পাশ করে বাপ্পী ভর্তি হন চট্টগ্রাম ল কলেজে। আইন পাশ করে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন বাপ্পী। বাপ্পী অবিবাহিত জানিয়ে আলী আহমদ বলেন, তার সঙ্গে কারো শত্রুতা ছিল কিনা জানা নেই। এক নারী একবার মামলা দিয়েছিল। পরে তা মিটমাট হয়ে গেছে বলে শুনেছি। কি নিয়ে মামলা সেটা জানতাম না। তার বাসায়ও কখনো যায়নি। চট্টগ্রামে কোন কাজে এলে হোটেলে উঠতাম। সেও হোটেলে আমাদের সঙ্গে থাকতো। তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছিলাম।

বাপ্পীর চাচা আবুল কালাম বলেন, বাপ্পী অবিবাহিত বলে আমরা জানতাম। এখন শুনছি সে এক আসামির বউকে বিয়ে করেছিল। এই বিয়ে কবে হয়েছিল আমরা জানি না। তবে বউকে তিন লাখ টাকা দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে আমরা এখন জানতে পেরেছি।

কে সেই নারী? : বাপ্পী খুনের পর থেকে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের রাশেদা নামে এক নারীকে নিয়ে দারুণ শোরগোল শুরু হয়েছে। পুলিশের ধারণা, বাসা ভাড়া নেয়া সেই নারী এই রাশেদা। মূলত: সে ফারুক নামে এক মাদক ব্যবসায়ির স্ত্রী। স্বামীর মামলার সূত্রে বাপ্পীর সাথে তার সখ্যতা, একপর্যায়ে তাঁরা গোপনে বিয়ে করেন। পরে আবার বিচ্ছেদ হয় দুজনের মধ্যে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় রাশেদা বেগম বাদি হয়ে বাপ্পীর বিরুদ্ধে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের অভিযোগে একটি মামলা করেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেফতার করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। পরদিন আদালত থেকে জামিন পান তিনি। ২০১৭ সালের এপ্রিলে কোতয়ালী থানায় বাপ্পী তার স্ত্রী রাশেদার বিরুদ্ধে দুইটি মামলা করেছিলেন। বাপ্পীর করা মামলায় রাশেদা ১৭ দিন জেল খাটেন। পরে তাদের মধ্যে মিটমাট হয়ে যায়। বাপ্পী খুনের পর পুলিশের প্রথম সন্দেহ এই রাশেদাকে ঘিরেই বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সকলেই তাদের বক্তব্যে জানিয়েছেন।

পাঠকের মতামত: