বিশেষ প্রতিবেদক ::
কক্সবাজার শহর থেকে সমুদ্রপথে ৮০ কিলোমিটার দূরে চকরিয়া উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ গোলদিয়ারচর ও চিলখালীর চর। এ দ্বীপে সড়ক পথে যাতায়াতের কোন মাধ্যম না থাকলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সমুদ্র পথ। চকরিয়া উপজেলার চরণদ্বীপ মৌজার এ জায়গাগুলো ১৯৭৭ ও ১৯৮৫ সালে সরকারীভাবে প্রকাশিত গেজেটভুক্ত বন ভুমি। উপকূলীয় বন বিভাগের আওতাধীন এ দ্বীপের পুরো এলাকাজুড়ে রয়েছে বাইন ও কেওড়া গাছ। এসব প্রাকৃতিক বন কক্সবাজার উপকূলকে প্রাচীর হিসেবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে আসছে। কিন্তু হঠাৎ করে সম্প্রতি বন খেকোদের আচঁড় পড়েছে সবুজ এ বনায়নে। বিচ্ছিন্ন ভাবে বেশ কিছু দিন ধরে গাছ কেটে আসলেও গত এক সপ্তাহে দুই লাখের উপর গাছ কাটা হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, একটি প্রভাবশালী সংজ্ঞবদ্ধ চক্র অন্তত দুই হাজার একর বন ভূমি অবৈধভাবে দখল করে চিংড়ী করার জন্য চলতি মার্চ মাসের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত অন্তত দুই লাখের অধিক গাছ কাটা হয়েছে এবং এ কাটা অব্যাহত আছে। পরিবেশ বিধ্বংসী এ র্কমযজ্ঞের নেতৃত্বে রয়েছে রয়েছেন চকরিয়ার এক জনপ্রতিনিধি ও কক্সবাজারের কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা।
এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনকে সাথে নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়কে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘পরিবেশ বিধ্বংসী এ র্কমযজ্ঞের সাথে যারাই জড়িত থাকুক প্রতিবেদন পাওয়ার পর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক কামরুল হাসান নির্দেশ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন,‘ র্উধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী সরেজমিন পরির্দশন করে নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিবেদন দেয়া হবে।’
গোলচর ও চিলখালীর চর এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্যারাবনের লক্ষাধিক বাইন ও কেওড়াগাছ কেটে সেখানে বেশ কয়েকটি চিংড়িঘের তৈরি করা হয়েছে। ঘের পাহারার জন্য তিন দিকে অন্তত ২০ টি ঘর তৈরি করে পাহারা বসানো হয়েছে। দিন-রাত পালাক্রমে সশস্ত্রভাবে পাহারা দিচ্ছেন ৩০ জন লোক।
কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে কয়েকশত শ্রমিক দুই লাখের বেশী বাইন ও কেওড়াগাছ কেটে ফেলেছে। এরপর গাছগুলো চকরিয়ার বিভিন্ন ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করা হয়। চকরিয়া ও কক্সবাজারের কয়েকজন প্রভাবশালী এই প্যারাবন নিধনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ১০-১৫ বছর বয়সী বড় বড় গাছ কাটা হয় করাত দিয়ে। আর ছোট গাছের প্যারাবনে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে ধ্বংস করা হয়। পরে গাছের মুথা বা গোড়ালি উপড়ে ফেলা হয়। কেউ এসে যেন প্যারাবনের চিহ্ন দেখতে না পান।
এলাকার বাসিন্দা আব্দুল জব্বার (৪০) বলেন, আগে এই প্যারাবনে হরিণ, বানর, বাদুড়, সাপ, বকসহ নানা পাখির বিচরণ দেখা যেত। প্যারাবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত এলাকায় কয়েক’শ পরিবার।
তিনি বলেন, কয়েক হাজার একরের প্যারাবনের লক্ষাধিক বাইন ও কেওড়া গাছ কেটে নিলেও বন বিভাগ নীরব ভূমিকা পালন করছে। তারা একটি গাছও উদ্ধার করতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা গোলাম মর্তুজার সাথে ফোনে যোগাযোগ করলেও বিভিন্ন ব্যস্থতা দেখিয়ে সংযোগ কেটে দেন।
স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রণমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ মামুন বলেন, চকরিয়া উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ গোলদিয়ারচর ও চিলখালীর চর এলাকায় পাঁচ লাখের চেয়েও বেশী বাইন ও কেওড়াগাছ ছিল। ইতিমধ্যে দুই লাখের বেশি গাছ কেটে চিংড়িঘের করায় উপকূলের ১০ লাখ মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অথচ বন বিভাগের কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছেনা।’
তিনি বলেন, কক্সবাজার উপকূলীলে প্যারাবন কেটে গড়ে উঠা চিংড়ি ঘেরগুলোর লীজ বাতিল করে নতুন করে যাতে আর কাউকে লীজ দেয়া না হয় এবং গাছ কেটে অবৈধ ভাবে দখলে নিয়ে চিংড়ি চাষের জমি উদ্ধাররের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে ৩ ফেব্রুয়ারী ইয়েস কক্সবাজারের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকার বনভূমি চিংড়ি চাষের জন্য জমি লীজ না দিতে হাইকোর্টের একটি নির্দেশনাও রয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানাযায়, ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- উপকূলীয় এলাকা চকরিয়া উপজেলার ১১ মৌজার ৮৯০৯.৫০ একর জমি চিংড়ি চাষের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অবৈধভাবে দখল করে চিংড়ি চাষ করছে ৩১০১.৫৩ একর জমি।
পাঠকের মতামত: