মুরাদনগর ও দাউদকান্দি (কুমিল্লা) প্রতিনিধি ::
ইউরোপ ও আমেরিকাসহ অন্তত ২৫টি দেশে খ্যাতি রয়েছে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশের বাঁশির। বৈশাখ ঘিরে এই গ্রামের বাঁশিওয়ালাদের ব্যস্ততা বেড়েছে।
শুরুর কথা
৯০ বছর বয়সী রুই দাস জানান, এক শ থেকে সোয়া শ বছর আগে প্রতিবেশী ভারত থেকে কোকিল দাস বৈরাগী এবং দীনবন্ধু শ্রীমদ্দিতে এসে বাঁশি তৈরি শুরু করেন। ১০০ বাঁশি তৈরি করে তাঁরা ফেরি করে বিক্রি করতেন। নিজেরা বাঁশি বাজাতেও পারতেন। স্বাধীনতার আগে বাঁশির বাজার ছিল ভালো। চৈত্র মাস এলে ঢাকার চকবাজারে এক থেকে দেড় লাখ বাঁশি বিক্রি হতো।
বহু নাম বহু ধরন
বাঁশি মূলত মুলিবাঁশ দিয়ে তৈরি হয়। সাধারণত ১৩ থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। হারমোনির স্কেলের চার ধাপ (২০ ইঞ্চি) পর্যন্ত বাঁশি তৈরি হয়। আর প্রতিটি বাঁশিতে তিন থেকে সাতটি ছিদ্র থাকে। আড়, বীন, বেলুন, ধ্রুপদী, খানদানি, তোতা, ফেন্সি ও মোহন বাঁশি তৈরি হয় এখানে।
তৈরির প্রক্রিয়া
একটি বাঁশি তৈরিতে ১৩-১৪টি ধাপ থাকে। প্রথমে মুলি কেটে শুকাতে হয়। পরে ছাচ (চামড়া) ছিলে ফেলা হয়। তবে আড় বাঁশির কোনো ছাচ ছিলানো হয় না। প্রতিটিতে ছিদ্র করার জন্য স্কেলের মাধ্যমে পেনসিল দিয়ে দাগ কাটা হয়। আড় বাঁশির ক্ষেত্রে কাদামাটি দিয়ে বিভিন্ন নকশা তৈরি করে আগুন দিয়ে সেঁক দেওয়া হয়। পরে বাঁশির গা থেকে মাটি শুকিয়ে পড়ে যায় এবং নকশা ফুটে ওঠে। চোখা শিক দিয়ে ছিদ্র করা হয়। সে কাজে কয়লা ব্যবহার করা হয়। মুখ ও তোতা কাটার পরে মান্দাল কাঠ দিয়ে কটি দেওয়া হয়। মৃসণ করতে শিরিষ দিয়ে ঘষা হয়। এরপর ধোয়ার কাজ শেষ করে বিভিন্ন রং দিয়ে নকশা করা হয়। পরে প্যাকেট করে বাজারজাত করা হয়।
দাম
ব্রিটিশ আমলে প্রতি হাজার বাঁশি ২০-৩০ টাকায় বিক্রি হতো। খুচরা এক আনায় বিক্রি করতেন পাইকাররা। পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি হয়ে এখন সাড়ে তিন টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত বেচা হয়। প্রতিটি বাঁশি খুচরা ১০ থেকে দেড় শ টাকা পর্যন্ত বেচা হয়।
ক্রেতা
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতারা বাঁশি কিনতে এই গ্রামে ভিড় জমায়। বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে চৈত্র মাসে ক্রেতার ভিড় বেশি হয়। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার দীনবন্ধু গত মঙ্গলবার এসেছেন বাঁশি কিনতে। তিনি বলেন, ‘৪৫ বছর ধইরা শ্রীমদ্দি থেকে বাঁশি কিনা নিয়া বিক্রি করতাছি। যুবকরাই বাঁশির মূলত ক্রেতা, শিশুরাও কেনে। এমনও দিন গেছে মেলায় এক দিনে এক হাজার বাঁশি বিক্রি করা যাইত। অহন বিক্রি কইমা গেছে। কারণ প্লাস্টিকের খেলনা এবং মোবাইলের দিকে যুবক ও শিশুদের আগ্রহ বাড়ছে। আর বিদেশের ক্রেতারা ঢাকার ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে নকশাসহ অর্ডার দেন।’
ক্রেতা কবির হোসেন বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে এসেছি। এক মাস আগে টাকা দিয়ে গেছি। আজ বাঁশি নিয়ে যাচ্ছি।’
কারিগরদের কথা
এই গ্রামের অন্তত ৩০টি পরিবার বাঁশি তৈরির কাজ করছে। এতে ৬০ বছরের বৃদ্ধ নারী-পুরুষ থেকে স্কুলগামী শিশুরা রয়েছে। নকশা তৈরি, ছিদ্র করা, ধোয়া-শুকানো এবং রং করার কাজ সাধারণত নারীরা করেন।
গ্রামের নিরঞ্জন চন্দ্র সরকার (৬১) বলেন, ‘১০-১২ বছর বয়স থেকে এ কাজ করছি। যারা বাঁশি তৈরি করে তাদের বলে বাঁশিওয়ালা, আর যারা বাজায় তাদের বলে শিল্পী।’
অনিল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘বাঁশির গুণগত মান বাড়িয়ে বিদেশে অধিক হারে রপ্তানি করা যাবে, যদি সরকারের সহযোগিতা পাওয়া যায়।’ যতীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস অভিযোগ করেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে বাঁশ এনে বাঁশি তৈরি করতে হয়। কুমিল্লা থেকে গৌরীপুর পর্যন্ত মহাসড়কে পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে বাঁশ আনা যায় না।’
এ বিষয়ে হোমনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খান মো. নাজমুস শোয়েব বলেন, ‘দেশি ঐতিহ্য ধরে রাখতে শ্রীমদ্দির বাঁশি তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া উচিত। তাদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। তারা যদি মনে করে সরকারি সহযোগিতা পেলে ব্যবসার প্রসার ঘটানো যাবে, সে জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
পাঠকের মতামত: