চন্দনাইশ উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে ফিরে এসেছে কাঞ্চন পেয়ারার সুদিন। এ পেয়ারায় ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে সহস্রাধিক পেয়ারা চাষির। শুধুমাত্র পেয়ারার চাষ করে অধিকাংশ পেয়ারাচাষি লাখপতি হয়েছেন। ওই তিন ইউনিয়ন হলো দোহাজারী, হাশিমপুর ও কাঞ্চনাবাদ। ইউনিয়নগুলোর পাহাড়ি এলাকায় শত শত বাগানে পেয়ারা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ফলন হয় কাঞ্চনাবাদের কাঞ্চননগর এলাকার পাহাড়ে। এ কারণেই এখানকার পেয়ারা ‘কাঞ্চন পেয়ারা’ নামে পরিচিত। কীটনাশক ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত এখানকার পেয়ারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে এবং ইউরোপের বাজারে। চলতি বছর উৎপাদন কম হলেও অন্যান্য বছরের তুলনায় দাম কয়েক গুণ বেশি। বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ভালো মানের পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকায়। অথচ অন্যান্য বছর এই সময়ে প্রতি ডজন পেয়ারা বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকায়। দাম বেশি থাকায় এ বছর পেয়ারা চাষিরাও খুশি। পেয়ারা চাষের সাথে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই তিন ইউনিয়নে এক থেকে দেড় হাজার বাগানে প্রতি বছর পেয়ারার চাষ হয়। প্রত্যেক বছর বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। এসব বাগানে উৎপাদিত কাঞ্চন পেয়ারা আকারে বড়, দেখতে সুন্দর, বিচি কম এবং পুষ্টিগণ সমৃদ্ধ। খেতে সুস্বাদু ও রসালো হওয়ায় সারা দেশে এই পেয়ারার চাহিদা বেশি। ফলে এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা চট্টগ্রাম শহর, ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলায় দ্রুত চলে যায়। চন্দনাইশ পেয়ারা বাগান মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, পেয়ারা চাষিরা প্রতি মৌসুমে প্রতিটি পেয়ারা বাগান ফড়িয়াদের সঙ্গে দরদাম করে এক মৌসুমের জন্য বিক্রি করে দেয়। বড় বাগানগুলো দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সবচেয়ে ছোট বাগানটিও পঞ্চাশ হাজার টাকার নিচে বিক্রি হয় না। এ এলাকায় শুধু পেয়ারা বাগান বিক্রি বাবদ আয় হয় কমপক্ষে পঞ্চাশ কোটি টাকা। এসব বাগান থেকে তুলে আনা পেয়ারা ফড়িয়ারা কয়েক গুণ বাড়তি মূল্যে বাজারে বিক্রি করে। ফড়িয়াদের কাছ থেকে পাইকাররা একই পেয়ারা কিনে নিয়ে আরেক দফা বাড়তি দামে খুচরা গ্রাহকদের মাঝে বিক্রি করেন। এভাবেই এ অঞ্চলে উৎপাদিত পেয়ারা বিক্রি বাবদ প্রতি বছর আয় হয় এক থেকে দেড়শ কোটি টাকা।
তবে উৎপাদিত এসব পেয়ারা বিক্রির জন্য ভালো ব্যবস্থা নেই। ফলে উৎপাদিত পেয়ারা বাজারজাত করতে চাষিদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। রোদ–বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাদেরকে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে বাজার বসাতে হয়। বাগিচাহাট, গাছবাড়ীয়া, বাদামতল এবং রওশনহাটে চাষিরা নিজেদের উদ্যোগেই অস্থায়ী বাজার বসান। এখানে পেয়ারা কিনতে আসা পাইকাররা নিজেদের ইচ্ছেমতো দামে পেয়ারা কিনে নেন। অভিযোগ আছে, পাইকারদের সিন্ডিকেটের বেঁধে দেয়া দামে চাষিরা যেদিন পেয়ারা বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানান, সেদিন পাইকাররা পেয়ারা না কিনে ফিরে যান। তখন অবিক্রিত পেয়ারা নিয়ে চাষিদের পোহাতে হয় ভোগান্তি।
সাম্প্রতিক সময়ে এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন ও দুবাইয়ে রপ্তানি হচ্ছে। তবে জানা গেছে, ওইসব দেশে এই পেয়ারার বিপুল চাহিদা থাকলেও নানা প্রতিকূলতার কারণে নিয়মিত রপ্তানি করা যাচ্ছে না। সরকারি সহযোগিতা পেলে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এখানে পেয়ারার আবাদ ভালো হয়। তবে বেশিরভাগ পাহাড়ের মালিক বনবিভাগ হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্তী নিয়ে প্রতি বছর খাজনা পরিশোধ সাপেক্ষে চাষ করতে হয়। এছাড়া বন্দোবস্ত নিতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
সরকারি উদ্যোগ ছাড়াই পেয়ারা বাগান থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় হচ্ছে। তাই বাগান করার উপযুক্ত পাহাড়ি জায়গাগুলো পেয়ারা চাষিদের মাঝে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার দাবি জানিয়েছে বাগান মালিকরা।
এদিকে কৃষি বিভাগ বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তর কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থা পেয়ারা চাষের আধুনিকায়নে এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এখানকার উৎপদিত পেয়ারা সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা নেই। পেয়ারা চাষিরা এখানে একটি আধুনিক হিমাগার স্থাপন এবং জেলি কারখানা প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন। তাছাড়া চাষের সাথে জড়িতদের আধুনিক প্রশিক্ষণসহ সুদমুক্ত ঋণ চান তারা।
চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লোকমান হোসেন মজুমদার বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে মাঠ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পেয়ারা চাষিদের পরামর্শ দেয়া হয়। পেয়ারার উৎপাদন আরো বাড়াতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পাঠকের মতামত: