বাংলাট্রিবিউন : ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের বয়ানে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদে উৎসাহ দেওয়া, ধর্মের নামে বিভিন্ন উপদল ও শোবিজ তারকাকে নিয়ে বিষোদ্গার, নারীদের পর্দা করা নিয়ে কটূক্তিসহ বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে ছয়টি সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (ইফাবা), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সব বিভাগীয় কমিশনারের কাছে এটি পাঠানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের মধ্যে মাহফিলে বক্তাদের মধ্যে যারা চুক্তিভিত্তিক অর্থগ্রহণ করেন তারা আয়কর দিচ্ছেন কিনা তা দেখা ও দেশবিরোধী বক্তব্য দিলে আইনের আওতায় আনার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। একইসঙ্গে উচ্চশিক্ষিত বক্তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে জরুরি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ইতোমধ্যে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে ইফাবা।
সুপারিশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওয়াজ মাহফিলে কী ধরনের বক্তৃতা হয় তা সবসময় আমাদের কাছে প্রতিবেদন আকারে আসে। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করি। আর বক্তারা কীভাবে করের আওতায় আসবেন তা দেখবে আয়কর বিভাগ।’
গত ১৯ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ ওয়াজ মাহফিল নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এগুলোর শিরোনাম: ওয়াজ মাহফিল কি পেশায় পরিণত হচ্ছে?, ‘আল্লাহ বলেন নো-নো, মুসা বলেন ইয়েস-ইয়েস’, ওয়াজ মাহফিলের যত ধারা, ওয়াজ রাজনীতি একাকার এবং ওয়াজ মাহফিল কীভাবে প্রভাব ফেলছে, শ্রোতা কি বাড়ছে?
সূত্রে জানা গেছে, মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ থেকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে মাহফিলের ১৫ জন বক্তার নাম উল্লেখ করে জানানো হয়েছে— ‘এই বক্তারা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্রবিরোধী ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী বয়ান দেন বলে লক্ষ করা যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা রেডিক্যালাইজড হয়ে উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বর্তমান সময়ের বক্তাদের আলোচ্য বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে নারী সম্পর্কিত বয়ানে কী কী আলোচনা করা হয়, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ পহেলা বৈশাখে নববর্ষ পালন নিয়ে বক্তাদের মন্তব্যের সারাংশ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নিয়ে বক্তাদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘মূর্তি ভাঙা ধর্মীয় কাজ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাফের’, ‘অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়’ প্রভৃতি মন্তব্য রয়েছে প্রতিবেদনে।
রাষ্ট্রের আইনবিরোধী মন্তব্য হিসেবে মাহফিলের বিভিন্ন বক্তাদের মন্তব্য যুক্ত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে— ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ধর্মনিরেপক্ষতাবাদ মুশরিকদের কাজ’, ‘শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, প্রতিমূর্তিতে ফুল দিয়ে নীরবতা পালন করা শিরক’, ‘গণতন্ত্র ইসলামে নাই, ইহা হারাম’ এবং ‘জাতীয় সংগীত কওমি মাদ্রাসায় চাপিয়ে দেওয়া যাবে না’ ইত্যাদি। জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়া বক্তব্য হিসেবে বক্তাদের ‘আল্লাহর রাস্তার প্রতিষ্ঠায় উত্তম জিহাদ হচ্ছে সশস্ত্র জিহাদ’, ‘আল্লাহ রাসূলকে গালি দিলে কোপাতে হবে’, ‘ইসলামের বিরুদ্ধে আইন করলে কোপাতে হবে’ মন্তব্যগুলো প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ওয়াজের বক্তারা প্রযুক্তির নানাবিধ ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ করে ইউটিউবে বিভিন্ন নামে চ্যানেল খুলে তাদের বিদ্বেষপূর্ণ ও উগ্রবাদী ওয়াজ প্রচারণা চালিয়ে আসছে।’
প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, ‘এ ধরনের ওয়াজ লাখ লাখ দর্শক এবং ওয়াজকারী ও শেয়ারকারীদের অধিকাংশই সরলমনা ধর্মপ্রাণ তরুণ মুসলিম। সেজন্য ওয়াজকারীদের উগ্রবাদী কথাবার্তা ও মনোভাব অবিরত দেশের তরুণ মুসলিম সমাজে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করছে। তারা দেশীয় সংস্কৃতি পালনে বিভ্রান্ত হচ্ছে। ফলে কিছুসংখ্যক লোক প্রতিশোধপরায়ণ ও জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছয়টি সুপারিশ হলো:
১. ওয়াজি হুজুররা যেন বাস্তবধর্মী ও ইসলামের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সংহতিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন, সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটি পুলিশের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।
২. যারা ওয়াজের নামে হাস্যকর ও বিতর্কিত বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করার চেষ্টা চালান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রো-অ্যাকটিভ উদ্বুদ্ধকরণ করা।
৩. অনেক আলেমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রির মতো উচ্চশিক্ষা ব্যতিত যারা ওয়াজ করে তারাই জঙ্গিবাদ ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাই মাদ্রাসায় উচ্চ শিক্ষিত ওয়াজকারীদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা।
৪. অনেকেই আছেন, যারা হেলিকপ্টারযোগে ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেন এবং ঘণ্টাচুক্তিতে বক্তব্য দিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেন। তারা নিয়মিত ও সঠিকভাবে আয়কর প্রদান করেন কিনা তা নজরদারির জন্য আয়কর বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগে কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করা।
৫. ওয়াজি হুজুরদের বক্তব্য স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক সংরক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া এবং উস্কানিমূলক ও বিদ্বেষ ছড়ানোর বক্তব্য দিলে তাদের সতর্ক করা। প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে তাদের ওয়াজ করার অনুমতি না দেওয়া।
৬. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারীদের আইনের আওতায় আনা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগের পরিচালক নূর মোহাম্মদ আলম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের মহাপরিচালক স্যার বৈঠক ডেকেছেন। আজ (রবিবার) এটি হওয়ার কথা। আমরা গবেষকদের সঙ্গে কথা বলছি। এ ব্যাপারে কী করা যায়, বক্তাদের ডাকবো নাকি তাদের চিঠি দেবো; এসব বিষয় সভায় ঠিক হবে। এরপর আমরা পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করবো।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, রবিবার (৩১ মার্চ) সন্ধ্যা পৌনে ৬টা নাগাদ একটি বৈঠক শুরু হয়েছে। এটি সোমবার (১ এপ্রিল) আবারও হতে পারে।
আগামী ৪ এপ্রিল ইফাবার মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের চিকিৎসার কাজে সিঙ্গাপুর যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে তিনি ফিরে এলে বক্তাদের বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে ইফাবা।
সামীম মোহাম্মদ আফজাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনই এ বিষয়ে কথা বলবো না। যেখান থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে সেখানে বলুন।’
পাঠকের মতামত: