ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

ওষুধ বাজারে ‘দুষ্ট চক্র’

করোনা চিকিৎসার সাথে নাম জড়ালেই বাজার থেকে উধাও, মেলে না সাধারণ ট্যাবলেটও

নিউজ ডেস্ক :: নগরীর জাকির হোসেন রোডের বাসিন্দা ইমরান আহমেদ ক’দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। করোনা উপসর্গে কার্যকর দেশীয় ওষুধ কোম্পানির কয়েকটি ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার। ইমরান আহমেদ জাকির হোসেন রোড, ওমেন কলেজ মোড়, জিইসি মোড় থেকে শুরু করে মেডিকেলের সামনে পর্যন্ত শ’ খানেক ফার্মেসিতে ঘুরেও ওষুধগুলো পাননি। পরে পরিচিত এক ফার্মেসি মালিকের সহায়তায় হাজারীগলি থেকে ষাট টাকা দামের ওষুধ চৌদ্দশ’ টাকায় হাতে পেয়েছেন তিনি। শুধু ইমরান আহমেদই নন, শহরের হাজার হাজার মানুষ কোন ওষুধ পাচ্ছেন না। করোনা আতংকের মাঝে ওষুধের আকাল দেখা দিয়েছে।

ইমরান আহমেদের প্রশ্ন- দেশীয় ওষুধ কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের এই আকাল কেন?
সূত্র জানিয়েছে, ভোগ্যপণ্য মজুদ করে কোটি কোটি টাকা বাজার থেকে হাতিয়ে নেয়ার মত সংঘবদ্ধ একটি দুষ্টু চক্রের চোখ পড়েছে ওষুধ ব্যবসায়ও। ইতোমধ্যে ওষুধ এবং স্যানিটাইজার মজুদ করে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংঘবদ্ধ চক্রটি। যথাযথ নজরদারির অভাবে ত্রিশ দিনে তিন বছরের ব্যবসা করেছে গুটিকয়েক মানুষ। করোনা চিকিৎসার সাথে নাম জড়ালেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে ওষুধ। মিলছে না নাপার মত সাধারণ ট্যাবলেটও।

সূত্র বলেছে, বৈশ্বিক মহামারী করোনার কোন ওষুধ আবিষ্কৃত না হলেও কিছু কিছু ওষুধ সেবনে এই রোগের প্রকোপ কমার কথা বলা হচ্ছে। করোনা হলে এন্টিহিস্টামিন, এন্টিম্যালেরিয়াল ও এজিথ্রোমাইসিন জাতীয় ওষুধ সেবনের কথা বলা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা ক্ষেত্রে করোনার এসব ওষুধের প্রচার হওয়ার সাথে সাথে বাজার থেকে ওষুধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। গত মাস দুয়েক ওষুধ এবং স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন জীবাণুনাশক সামগ্রী নিয়ে অস্বাভাবিক বাণিজ্যে মেতেছে দেশ। শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে মানুষের পকেট থেকে।

অতি সাধারণমানের ওষুধগুলো রাতারাতি বিশেষ মর্যাদা পেয়ে যায়। দোকানে দোকানে ঘুরেও ওষুধগুলো পাওয়া যায় না। সব দোকানেরই একই কথা-‘নেই।’ পরবর্তীতে পরিচিত কাউকে ধরে চড়া দাম ম্যানেজ করতে পারলে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত নিশ্চিত কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। বিশ্বের নানা দেশ ওষুধ আবিস্কারের চেষ্টা করছে। তবে কয়েকজন চিকিৎসক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু কিছু ট্যাবলেটের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, এগুলো সেবনে করোনা উপসর্গ কমে যায়। রোগ ভালো হয়। আর এরপর থেকেই ওষুধগুলোর বাজারে আকাল লাগে।

বিশেষ করে ট্যাবলেট ইভারমেকটিন (৬ মিলিগ্রাম) সেবনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, রোগীর ওজন ৬০ কেজির নিচে হলে ২টি ট্যাবলেট এবং ৬০ কেজির ওপরে হলে ৩টি ট্যাবলেট একসঙ্গে খালি পেটে ১ বার খেতে হবে। ইভারমেকটিন-এর এই ট্যাবলেট স্ক্যাবো, ইভরা, প্যারাকিল ইত্যাদি নামে বাজারে পাওয়া যায়। ট্যাবলেট ফ্যাভিপিরাভির (২০০ মিলিগ্রাম) খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই ট্যাবলেট বাজারে এ্যাকারভিয়া, ফ্যাভিপিরা, এ্যাভিগান ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। ম্যালেরিয়ার ট্যাবলেট হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন বাজারে পাওয়া যায় রিকোনিল নামে। অতি সহজে এসব ওষুধ পাওয়া যায় গলির মুখের ফার্মেসি থেকে শুরু করে বড় বড় সব ফার্মেসিতে। কিন্তু করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে এসব ওষুধ সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। বেক্সিমকো, স্কয়ারসহ দেশীয় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের এই আকাল সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। নাপার মতো অতি সাধারণ ওষুধ পাওয়াও কঠিন হয়ে উঠেছে।
গতকাল একাধিক ফার্মেসি মালিকের জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে প্যারাসিটামল, এন্টিহিস্টামিন, এন্টিম্যালেরিয়াল, ভিটামিন সি ট্যাবলেট ও এ্যাজিথ্রোমাইসিন জাতীয় ওষুধের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ওই সব ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে।

আর এই সংকটকে পুঁজি করে দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তারা বলেন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে করোনার জন্য যেসব ওষুধের নাম করা হচ্ছে সেগুলোর বিক্রিই বেড়ে যাচ্ছে। শুধু ওষুধই নয়, যে যা বলছে তার ব্যবহার বাড়ছে। বিক্রি বাড়ছে। আদা, জিরা থেকে শুরু করে লেবু পর্যন্ত সব জিনিসের ব্যবহার বেড়েছে। বিক্রি বেড়েছে। করোনা আসার আগেই আতংক থেকে মানুষ ঘরে ঘরে ওষুধের মজুদ করেছে। নিজের পরিবার পরিজনের জন্য ওষুধ কিনে ঘরে ঘরে রাখায় কোম্পানিগুলো ওষুধ সরবরাহ দিয়ে কুল করতে পারছে না। এতে করে নানা ঘাটে দাম বাড়ানো হচ্ছে।

জাকির হোসেন রোডের একটি ফার্মেসির মালিক বলেন, হাজারীগলি থেকে নিয়মিত ওষুধ কিনি। অথচ এখন পাইকারি দোকানের মালিকেরা চোখের দিকে তাকাচ্ছেন না। ওষুধ নেই। যা চাচ্ছি তা দিচ্ছেন না বা দিতে পারছেন না। চড়া দাম দিলে ওষুধ দেয়ার কথা স্বীকার করে ওই ফার্মেসি মালিক বলেন, বিষয়টি ঠিক। ক্রাইসিস থাকলে দাম তো বাড়বে। ক্রাইসিস থাকায় বাড়তি দাম আদায় করা হচ্ছে। তবে করোনা আক্রান্ত হওয়ার আগে যদি মানুষ হুড়োহুড়ি করে এসব ওষুধ না কিনতেন তাহলে বাজার পরিস্থিতি এমন হতো না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, রোগ হলেই ওষুধ কিনতে হবে। কিন্তু রোগ হওয়ার আগে ওষুধ কিনে রাখায় বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। দেশীয় ওষুধ কোম্পানি গুলোর মধ্যে এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, জিসকা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসসহ কয়েকটি কোম্পানি করোনা উপসর্গের চিকিৎসায় কার্যকর এমন ওষুধগুলোর উৎপাদন করছে। ওষুধ প্রশাসনও এসব উৎপাদনের অনুমতি প্রদান করেছে। কিন্তু এসব ওষুধ সোনার হরিণ হয়ে উঠায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। অসুস্থ মানুষকে এসব ওষুধ কিনতে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হচ্ছে।

প্রতিবেদক একাধিক চিকিৎসকের সাথে কথা হয়েছে। ডাঃ আমজাদ হোসেন বলেন, করোনার জন্য প্রকৃতপক্ষে প্রমাণিত কোনো ওষুধ নেই। তবে যেসব ওষুধ খেলে উপকার হচ্ছে সেগুলোই চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন। একেকজন রোগীর কন্ডিশান একেক রকম। একেক জনের শরীরে উপসর্গ একেকভাবে কাজ করে। এখন একজনের জন্য যে ওষুধটি কাজ করেছে সেটি অন্যজনের শরীরে একইভাবে কাজ নাও করতে পারে। তিনি বলেন, চেম্বার বন্ধ থাকায় অনেক চিকিৎসক তাদের রোগীকে অনলাইনে প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন। সেই প্রেসক্রিপশন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে আর ওষুধের আকাল তৈরি করছে।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের রেজিস্টার ডা. লক্ষ্মীপদ দাশ সম্প্রতি করোনা জয় করে ফিরেছেন। গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, করোনার চিকিৎসা একটি গাইডলাইন অনুসারে চলে। কিন্তু অনেকে স্ক্যাবো ট্যাবলেট ও ডক্সিসাইক্লিন ক্যাপসুলসহ নানান ওষুধ ফার্মেসি থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এসব ওষুধ করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় কার্যকর বলে এখনও প্রমাণিত হয়নি।
ডাক্তার আহসান ফুয়াদ অয়ন বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজেদের মতো করে ওষুধ কিনে খাওয়া খুবই ক্ষতিকর। এটি বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনের শীর্ষ একজন কর্মকর্তার  সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ওষুধের বাজার নিয়ে যা হচ্ছে এক কথায় তা অমানবিক। একটি ‘দুষ্টু চক্র’ ওষুধের বাজারকে জিম্মি করে নানাভাবে ফায়দা হাসিল করছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসন অচিরেই অভিযান শুরু করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পাঠকের মতামত: