চট্রগ্রাম প্রতিনিধি ::
এবারের কোরবানির ঈদে শুধু চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি থেকে পাঁচ লাখের বেশি গবাদি পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হবে বলে আশা করছেন কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির নেতারা। এর মধ্যে গরুর চামড়া প্রায় চার লাখ। এছাড়া ছাগল, ভেড়া ও মহিষের চামড়া পাওয়া যাবে আরো এক লাখের বেশি। গত বছর সাড়ে চার লাখ চামড়া সংগ্রহের টার্গেট থাকলেও বাস্তবে হয়েছে প্রায় চার লাখ।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের হিসাব মতে, ২০১৭ সালে চট্টগ্রামে ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৮৩১টি পশু কোরবানি হয়েছিল। এর মধ্যে গরু ৪ লাখ ১০ হাজার ৩৮৪, মহিষ তিন হাজার ৩টি, ছাগল-ভেড়া এক লাখ ৮২ হাজার ৪৪১টি এবং অন্যান্য পশু ৩টি।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির উপদেষ্টা ও সাবেক সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবছরই কোরবানিদাতার সংখ্যা বাড়ছে। সে হিসাবে গতবারের তুলনায় এবার গবাদি পশুর চামড়াও বেশি সংগ্রহ হবে। প্রতিবছর ৩/৪ স্তরের ব্যবসায়ীদের হাত বদল হয়ে একেকটি চামড়া আড়তে পৌঁছে। সেখানে প্রায় দুই মাস লবণজাত করে রাখার পর ট্যানারিতে সরবরাহ করা হয়।’
তিনি জানান, চট্টগ্রামের কোরবানির পশুর ৮০ শতাংশ চামড়া ঢাকায় চলে যায়। ঢাকার ট্যানারি মালিকরা কিছু টাকা নগদ দিলেও অধিকাংশ টাকা বাকি রাখে।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির নেতারা জানান, চলতি বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুট ওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতিবর্গফুট গরুর চামড়ার ক্রয়মূল্য ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করেছে।
গত বছর ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতিবর্গফুট গরুর চামড়ার ক্রয়মূল্য ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, অন্যান্য জেলায় ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। ২০১৬ সালে ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতিবর্গফুট গরুর চামড়ার ক্রয়মূল্য ছিল সর্বোচ্চ ৫০ টাকা এবং অন্যান্য জেলায় ছিল ৪০ টাকা।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির উপদেষ্টা মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দরপতন এবং চামড়া শিল্পে ব্যবহৃত কেমিক্যালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে।’ এ কারণে চামড়ার দাম কমেছে বলে মন্তব্য করেন প্রবীণ এই ব্যবসায়ী নেতা।
নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহের জন্য আতুরারডিপো থেকে হামজারবাগ পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ব্যাপকভাবে আগাম প্রস্তুতি চলছে। এ ছাড়া নগরীর আগ্রাবাদ, চৌমুহনী, অলঙ্কার মোড়, নয়াবাজার মোড়, কালুরঘাট, বাকলিয়া, চকবাজার, সিইপিজেড মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে অস্থায়ী আড়ত গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে।
কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির নেতারা আরো বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা লবণযুক্ত প্রতিবর্গফুট গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে তাই আমাদেরকে আরো কম দামে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করতে হবে। এরপর প্রক্রিয়াজাত ও লবণযুক্ত করে বিক্রি করতে হবে। কারণ প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে অন্তত ১২ টাকা খরচ পড়ে।
চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, নগরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ছোট চামড়া ৫০০-৬০০ টাকায় এবং বড় চামড়া ৮০০-১০০০ টাকায় সংগ্রহ করেন। পরে তা মধ্যস্বত্বভোগীরা কিনে চৌমুহনী, অলংকার মোড়, নয়াবাজার মোড়, কালুরঘাট, বাকলিয়া, চকবাজার, সিইপিজেড মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করেন। সেখান থেকে নগরের প্রধান চামড়ার আড়ত আতুরার ডিপোতে এসে পৌঁছতে চামড়ার দর ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায় দাঁড়ায়।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. সেকান্দর বলেন, ‘ট্যানারি ব্যবসায়ীরা ৪০ টাকার বেশি দিতে চাইবেন না। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ৫০ থেকে ৬০ টাকার কমে চামড়া কেনা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ, তাঁরা যেন চামড়া কেনার সময় বুঝে শুনে কেনেন এবং রোদের তাপে চামড়া যেন নষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ রাখেন।’
চামড়ার বাজারের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত পুলিশ ও র্যাব : কোরবানি ঈদের দিন শুধু চামড়া বিকিকিনি সংক্রান্ত কাজে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে থানা ও ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যদের বাইরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে নগরে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, নগরে ঈদের দিন থেকেই শুরু হয় চামড়া বিকিকিনি। নগরের ৫৪ স্থানে চামড়া বিক্রি হবে। চামড়া যাতে কোনোভাবেই পাচার না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা হবে। নগরে চামড়া বিক্রিকেন্দ্রিক নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন।
লবণের দাম স্বাভাবিক
প্রতিবছর চামড়া সংগ্রহের মৌসুমকে পুঁজি করে লবণের দাম বাড়লেও এবার এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। এ বছর লবণের দাম স্বাভাবিক রয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামে লবণের বস্তা (৭৪ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। গত বছর এই সময়ে লবণের বস্তা বিক্রি হয়েছিল ১২০০ থেকে ১২৬০ টাকা দরে। গত বছর কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে লবণের দাম বাড়ানো হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ লবণ চাষি কল্যাণ পরিষদের নেতারা জানান, এ বছর দেশে লবণের চাহিদা ১৫ লাখ ৭৬ হাজার টন। বিপরীতে দেশে লবণ উত্পাদন হয়েছে ১৩ লাখ ৬৪ হাজার টন। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার টন। গত বছর (২০১৭) কোরবানির ঈদের আগে সরকার ৫ লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। সেই লবণের চালান দেশে পৌঁছার আগেই কোরবানির ঈদ চলে যায়। গত বছরের আমদানি করা লবণের একটি অংশ দিয়ে এ বছর ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে।
চামড়ার আড়তদাররা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, গবাদি পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সময় যেন দেশি লবণ ব্যবহার করা হয়। দেশি লবণ ব্যবহার করলে চামড়ার গুণ-মান ভালো থাকে।
পাঠকের মতামত: