ঢাকা,সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

এই সিইসির অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না : বিএনপি

photo-1486493225প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি)নেতৃত্বে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি হতাশ ও ক্ষুব্ধ,এই কমিশন প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেরই প্রতিফলন। এই কমিশন কতটা নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।

মঙ্গলবার রাতে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ সময়  বিএনপি ও জোটের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। ২০ দলীয় জোটভূক্ত প্রত্যেকটি  দলও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালনে নীতিতে আমরা বিশ্বাসী। দুর্ভাগ্যক্রমে ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সেই প্রত্যাশাকেই ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে গভীর জাতীয় সংকট। আর তাই এবারের নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি বিএনপি শুরু থেকেই অসীম গুরুত্ব ও গভীর ঐকান্তিকতার সঙ্গে নিয়েছিল।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম যাদেরকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে,তাঁরা হবেন সৎ,দল নিরপেক্ষ, দক্ষ, সাহসী, প্রজ্ঞাবান,কর্ম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য। এই উদ্দেশ্যেই বিএনপির চেয়ারপারসন  ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গত ১৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে ১৩ দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে উপস্থাপন করেন। দেশনেত্রীর এই  যৌক্তিক প্রস্তাবে দেশবাসী উৎসাহিত হয় এবং যথার্থই নিরপেক্ষ,যোগ্য ও সাহসী একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে বলে আশা করে।

মির্জা ফখরুল আরো বলেন, ‘৬ ফ্রেব্রুয়ারি শেষ মুহূর্তে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত ১০ নাম থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ৪ জনকে নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সকল মহল থেকে দাবি ছিল সার্চ কমিটি কর্তৃক বাছাইকৃত এই ১০ জনের নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। তাদের জীবন বৃত্তান্ত ও কর্ম অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা হবে। এ পন্থা অনুসরণ করা হলে প্রক্রিয়াটি কিছুটা হলেও স্বচ্ছতা পেত। কিন্তু তা করা হয়নি। আমরা নিরাশ ও হতাশ হয়েছি।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘শেষ মুহুর্তে রুদ্ধশ্বাস দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। এ সব সন্দেহের মধ্যেও একটি বড় সন্দেহ হল কাদেরকে নির্বাচন কমিশনে রাখা হবে সেটি ছিল শাসকমহলের পূর্ব পরিকল্পিত। ‘রাষ্ট্রপতি যে সিদ্ধান্ত নিবেন সেই সিদ্ধান্তই আমরা মেনে নেব’ এই উক্তি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আসলে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন। সাংবিধানিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী দুটো বিষয় ছাড়া (প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ) অন্য সব বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য। সঙ্গত কারণেই আমরা মনে করতে পারি বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেরই প্রতিফলন ঘটেছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত কে এম নুরুল হুদা যুগ্ম সচিব হিসেবে চাকুরি জীবন শেষ করেন। অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব হয়েছেন শুধুই কাগজে। প্রকৃত পক্ষে তিনি একদিনের জন্যও অতিরিক্ত সচিব কিংবা সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নাই। ফলে এইসব পদে দায়িত্বপালনের কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা তার নেই। অভিজ্ঞ সচিব ছাড়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের এই ঘটনা অভূতপূর্ব। রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়া এমন হওয়ার কথা নয়।’

ডেইলি স্টারে নতুন নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন,সেই তথ্য থেকেই ধরে নেওয়া যায় আমাদের দল সম্পর্কে তাঁর মনে ক্ষোভ থাকতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ শাসনামলে ভুতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়ে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরাগ পোষণ করতে পারেন। এই দুই বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যে তিনি কতটুকু নিরপেক্ষতা অবলম্বন করবেন সে ব্যাপারে জনমনে যৌক্তিক প্রশ্ন রয়েছে। একটি নির্বাচন কমিশনের যাত্রা শুরুতে আস্থার সংকট ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যার জন্ম দিতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিএনপির মহাসচিব আরো বলেন, সর্বোপরি অভিযোগ আছে তিনি ১৯৯৬ সালে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক হিসেবে বিএনপি সরকার বিরোধী জনতার মঞ্চের একজন সংগঠক ছিলেন। অথচ কর্মরত সরকারি কর্মকর্তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারেন না। এমন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া সরকারি চাকুরি বিধির নিদারুণ লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।  অন্যদিকে ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তিনি মিউনিসিপাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড নামের সরকারি একটি প্রজেক্টের এম.ডি হিসেবে সরকারের লাভজনক পদে কাজ করেছেন। আমরা সরকারি চাকুরি শেষে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিতদের নির্বাচন কমিশনে অন্তর্ভূক্ত না করার প্রস্তাব করেছিলাম এই জন্য যে,সাধারণত: সরকারের অনুগ্রহভাজনদেরই এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম কারো কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ কিংবা কারো প্রতি ক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি যেন নির্বাচন কমিশনের মতো নিরপেক্ষ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ না পান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাই হয়েছে। এসব কারণে স্বাভাবিক ভাবেই জনমনে কে এম নুরুল হুদা সম্পর্কে নেতিবাচক উপলব্ধি সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি সার্চ কমিটি এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিবেচনায় না নেওয়া খুবই রহস্যজনক।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা মনে করি এমন একজন বিতর্কিত সাবেক সরকারি কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত কোনো প্রতিষ্ঠান নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। কাজেই এই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে সুষ্ঠু,অবাধ,নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। এমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের পর নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে আমাদের প্রস্তাবের যৌক্তিকতা আরো দৃঢ় হয়েছে।’

এর আগে ৬ ফেব্রুয়ারি সাবেক সচিব খান মোহাম্মদ নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) করে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাঁদের নিয়োগে অনুমোদন দেন।

এ ছাড়া কমিশনার হয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, রাজশাহীর সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বেগম কবিতা খানম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনে এবার প্রথমবারের মতো একজন নারী আসলেন।

এর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত ১০ নামের তালিকা প্রকাশ করেন। পরে তিনি সিইসি ও অন্য কমিশনারদের নামের কথা জানান। ওই দিন সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি তাদের প্রস্তাবিত ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে দেয়। সেখান থেকেই রাষ্ট্রপতি সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেন। সার্চ কমিটি সিইসি হিসেবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ও সাবেক সচিব কে এম নুরুল হুদার প্রস্তাব করেছিল।

 এ ছাড়া কমিশনার হিসেবে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জারিনা রহমান খান, সাবেক সচিব মো. রফিকুল ইমলাম, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, রাজশাহীর অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম কবিতা খানম, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য মো. আবদুল মান্নান, ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী, নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ নিয়োগ পেয়েছেন।

ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বঙ্গভবনে যান সার্চ কমিটির ছয় সদস্য। সেখানে তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে নামের তালিকা ও এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন তুলে দেন। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যান সার্চ কমিটির সদস্যরা। বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে আজ বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠকে সার্চ কমিটি ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করে। সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে এ বৈঠক হয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের মেয়াদ হচ্ছে আজ বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি)।

বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি নিজেদের মধ্যে চার দফা বৈঠক ছাড়াও প্রথমে ১২ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং পরে আরো চারজনের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া ৩১টি দলের মধ্যে ২৬টি দলের কাছ থেকে পাঁচটি করে নাম জমা নিয়েছে তারা। বাকি দলগুলোর চারটি সার্চ কমিটিতে নাম দেয়নি আর একটি দল নির্ধারিত সময়ের পর নাম জমা দেওয়ায় তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।

নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ নিয়ে গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত মোট ৩১টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। আর এই সংলাপ শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পর গঠন করা হয় সার্চ কমিটি। ২০১২ সালেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়ার আগে সে সময়ের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিলেন।

পাঠকের মতামত: