অনলাইন ডেস্ক ::
এই আমেরিকার সবচেয়ে নামকরা লেখক তিনি। তাঁর নাম মার্ক টোয়েন। তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাসের নাম- দি প্রিন্স এ্যান্ড দি পপার। কেউ সামান্য অবস্থা থেকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছালে আমার শুধু ওই ধ্রুপদী উপন্যাসটির কথা মনে হয়। নয়ত যে মানুষটি ছিলেন সামান্য রিফিউজি। সহায় সম্বলহীন অবস্থায় কলকাতা থেকে এসেছিলেন ঢাকা শহরে। খোলা আকাশের নীচে থেকেছেন। সামান্য পাউরুটি কলা কিনে খাবার মতো পকেটে টাকা ছিল না। সেই তিনি একদিন হলেন শহরের রাজা। অর্থ-বিত্তে নয়, মানুষের ভালোবাসার মুকুট পরলেন মাথায়। আর আসল রাজার কথা কেইবা কত দিন মনে রাখে? মানুষের অন্তর যিনি জয় করতে পারেন, তিনিই তো আসল রাজা!
তার পুরো নাম আবদুর রাজ্জাক। সিনেমায় তার নাম ছিল রাজ্জাক। বিখ্যাত সিনে সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরী তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন নায়করাজ। আর মোর মতো অনেক বরিশাইল্যা আছে যারা তার নাম ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতো না, বলতো- ‘রজ্জাক’। সেই মানুষটি রাজার মতোই কাউকে বিরক্ত না করে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। দিনটি ছিল ২১শে আগস্ট সোমবার। গ্রীস্মের ছুটিতে নিউ ইয়র্ক শহরের কোলাহল ছেড়ে চলছিলাম নিরিবিলি, প্রাকৃতিক শোভা পরিবেষ্টিত স্থানের খোঁজে। যাবার আগে সকাল বেলা জানতে পারলাম রাজ্জাকের মৃত্যু সংবাদ। তারপর পুরোটা পথ পুরনো দিনের গান আর টুকরো টুকরো সিনেমার দৃশ্যে একজন অসামান্য অভিনয় শিল্পীর স্মৃতি রোমন্থন করলাম। অবকাশের আনন্দ মুছে গিয়ে পুরোসময় চাপা বিষাদে ছেয়ে থাকল মন।
আমার মা আর খালারা ছিলেন গ্রামের মানুষ। উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেনের সিনেমা দেখার সুযোগ তাদের হয়নি। দুপুরে-রাতে খাওয়ার পরে ট্রানজিস্টার আর তাতে অনুরোধের আসরই ছিল তাদের সেরা বিনোদন। নাড়া পোড়ার গন্ধ আর ডাহুকের ডাকে নামতো সন্ধ্যা। সেই পটভূমিতে মিশে থাকতো চেনা সুর, চেনা কণ্ঠ। আমার মা ষাট কিংবা সত্তর দশকের যে কোনো গান শুনে বলে দিতে পারতেন, কে গেয়েছেন? মাহমুদুননবী, খন্দকার ফারুক আহমেদ, বশির আহমেদ নাকি মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী? কিন্তু তারা তো নেপথ্যের শিল্পী। রূপালী পর্দায় যে মানুষটি এসব গায়কের সুরকে কণ্ঠে ধারণ করতেন, তিনি তো একজনই-রাজ্জাক। নায়করাজের মৃত্যুর পরে কথা বলেছিলাম আমার ছোট খালার সাথে। উনি খুব মর্মাহত। রাজ্জাক আজো তার প্রিয় নায়ক। আর ববিতা। তিনি বললেন, আমি কখনো রাজ্জাক আর ববিতার বেশি বয়সের কোনো সিনেমা দেখিনি। ওরা আমার শুধু প্রিয় না, স্বপ্নের জুটি।
রাজ্জাক ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের একটি মানদণ্ড। ষাট ও সত্তর দশকে তার অভিনীত সিনেমাগুলো এখনো সব বিচারে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সেরা সম্পদ। তিনি সব শ্রেণির দর্শকের নায়ক ছিলেন। মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীদের ও সমানভাবে আকৃষ্ট করেছেন। রাজ্জাকের পরে একমাত্র অকাল প্রয়াত সালমান শাহ ছাড়া কোনো নায়ক ঢুকতে পারেনি মধ্যবিত্তের ড্রইংরুমে। কিছুদিন আগে সালমান শাহকে নিয়ে একটি লেখা লিখতে গিয়েও আমি টেনে এনেছিলাম রাজ্জাককে। বলেছিলাম আমার এক ফুফুর কথা। আমার সেই বরিশালের ফুফু রাজ্জাককে বলতো ‘রজ্জাক’। কোনো এক সিনেমায় কঠিন পরিস্থিতিতেও নায়কের দেখা নেই। সবাই খুব উদ্বিগ্ন। এমন সময় নায়ক এসে হাজির। ফুফু উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন ‘রজ্জাক’ বলে। সিনেমা হলের সব দর্শক পর্দার দিকে না তাকিয়ে ফুফুর দিকে তাকিয়ে হেসেছিল সেদিন।
আমরা বাড়ির লোকেরা একত্রিত হলে ফুফুর সেই ‘রজ্জাক’ এর গল্পটা প্রায়ই করি। নায়করাজকে নিয়ে এমন গল্প অনেকের আছে। যেমন একজন লিখেছিলেন, আশির দশকে তার একটা ভিউকার্ড ছিল, ছবিতে সপরিবারে রাজ্জাক বসেছিলেন। ওই ভিউকার্ডটা এক সময় আমারও ছিল। মনে পড়ে গেল সেই কথা। আমার পরিচিত আরেকজন লিখেছিলেন, রংবাজ সিনেমার কথা। ওই সিনেমা দেখে তিনি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, কেরোসিন খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল তাকে। ‘রংবাজ’ বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশনধর্মী সিনেমা। রাজ্জাক সেখানে অভিনয় করেছিলেন। আমার সেই পরিচিত তাঁর লেখায় দু:খ করে বলেছেন, সম্প্রতি এক টেলিভিশনে এসেছিলেন ‘রংবাজ’ রাজ্জাক। কিন্তু অনুষ্ঠানে উপস্থাপিকার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি রাজ্জাকের চেয়েও বড় তারকা। তাঁর মন্তব্য, যে দেশে যোগ্য লোকের মূল্যায়ন হয় না, সেই দেশে রাজ্জাকের মতো মানুষের চলে যাওয়াই শ্রেয়।
১৯৬৬ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পরে শহর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাজ্জাক। অথচ তাঁর জন্ম ওই শহরের টালিগঞ্জে। বাংলাদেশে সিনেমা শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শুনে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। সাথে ছিল ফেলে আসা নাট্যদলের নাট্যকার পীযূষ বসুর একটি প্রশংসাপত্র। ঢাকা স্টেডিয়ামে কলকাতা থেকে আসা আরো শত শত রিফিউজির সাথে স্ত্রী ও শিশু পুত্রকে বসিয়ে রেখে দেখা করতে গিয়েছিলেন ‘মুখ মুখোশ’ সিনেমার পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের সাথে। ‘উজালা’ নামের এক সিনেমায় পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারীর কাজ পান। প্রথম অভিনয় করেন ‘তের নম্বর ফেকু ওস্তাদগার লেন’ সিনেমার একটি ছোট্ট চরিত্রে। জহির রায়হান তাঁকে খুুঁজে নিয়ে সুচন্দার বিপরীতে ‘বেহুলা’ সিনেমায় কাজের সুযোগ দেন। এভাবে সুচন্দা, কবরী, শবনম, সুজাতা, ববিতা, শাবানা, সুচরিতা, রোজিনা, অঞ্জনা….সবার বিপরীতে নায়ক হয়েছেন। রিফিউজি থেকে হয়েছেন নায়করাজ। তবু দেশান্তর, রিফিউজি জীবন, নিদারুণ দারিদ্র্যের সেই দিনগুলোকে কোনোদিন ভুলতে পারেননি তিনি। অকপটে সব সময় স্বীকার করেছেন নিজের জীবনের সংগ্রামের কথা। আর এটাই তাকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে।
রাজ্জাক যেদিন চলে গেলেন, নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে রাজধানী আলবেনির দিকে যাচ্ছিলাম গাড়িতে। চারদিকে নদী, পাহাড়, হৃদ, উপত্যকা-অপার্থিব সৌন্দর্য চারদিকে। দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রাজ্জাকের পুরনো সিনেমার গানগুলো দেখছিলাম। কারণ তাঁর ওই চেহারাটাই মানস পটে উজ্জ্বল। নাচের পুতুল সিনেমায় ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ গানটা শুনতে শুনতে অনেকদিন আগে একজনের কথা মনে হলো। আমার পরিচিত সেই ব্যক্তি বলেছিলেন, নাচের পুতুল সিনেমায় রাজ্জাককে উত্তম কুমারের চেয়ে সুদর্শন লেগেছিল তার কাছে।
পাঠকের মতামত: